Almamun Ashrafi's Bangla Article
কবে কারিগরি শিক্ষা উঠবে আভিজাত্যের আঙ্গিনায়?
১৫ কোটি মানুষের দেশে চাহিদা অনুযায়ী স্কিল্ড ওয়ার্কারের অভাব! অথচ চায়না ও ইন্ডিয়া সমস্ত পৃথিবীর অর্ধেক পপুলেশন (২৫০ কোটী) নিয়ে উল্কার বেগে স্কিল্ড ওয়ার্কার তৈরী করছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা ও ওশেনিয়া। এ অভাব পূরণে বাংলাদেশ সরকারও যথাসাধ্য চেষ্টা করে আসছে শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে – এনালগ থেকে ডিজিটালে পদার্পণ(!)। নানা বাধাবিপত্তির পরও কিছু স্কিল্ড ওয়ার্কার দেশে তৈরী হচ্ছে কিন্তু শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর আর প্যাভিলিয়নে ফিরতে পারছে না তারা। এর কারণ অনেক বিবিধ যা নিয়ে বিস্তর গভেষনা হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এর সবচেয়ে বড় বাধা হল শহরের তুলনায় গ্রামীন অবকাঠামো অত্যন্ত দূর্বল যেমন বেসিক নিডস এখানে শুন্যের কোঠায় (দুস্থ্যঃ প্রাইমারি শিক্ষা ব্যবস্থা, হাইস্কুল/কলেজ নাগালের বাইরে, স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল, ইত্যাদি), ফলে মানুষ গ্রামবিমুখ। আবার বিদেশের তুলনায় আমাদের দেশের শহরের অবকাঠামো অত্যন্ত নাজুক যেমন লাইফ সিকিউরিটি শুন্যের কোঠায়, যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মের অভাব, উচ্চশিক্ষিত মানুষ দেশবিমুখ। অর্থাৎ সামষ্টিক স্কিল্ড ওয়ার্কার এবং শিক্ষিত/উচ্চশিক্ষিত মানুষগুলো গ্রামবিমুখ ও শহরবিমুখ।
কোন জাতির স্কিল্ড ওয়ার্কার তৈরীতে যেমন উচ্চশিক্ষা জরুরী, তেমনি জরুরী ভকেশনাল ট্রেনিং (Vocational Education and Training – VET)। পেশাগত অর্থে, ভকেশনাল শিক্ষাব্যবস্থা (ভেট) হল কাউকে চাকুরী বা কর্মের জন্য উপযুক্ত করে তৈরী করা। ভেট শিক্ষাব্যবস্থা শুধু যে নিদির্ষ্ট সাবজেক্ট বা বিষয়-ভিত্তিক হতে হবে তা কিন্তু নয়, যে কোন বিষয়ের উপর ডিপ্লোমা করা যায় যদি টেকনিক্যাল ও লজিষ্টিক সাপোর্ট থাকে। সামষ্টিক অর্থে ভেট ট্রেনিং ব্যবস্থা নির্ভর করে কোন দেশের আর্থসামাজিক ও ইনভায়ারমেন্টাল পেক্ষাপটের উপর। এ অর্থে পৃথিবীর যে কোন দেশের চেয়ে আমাদের দেশের ভেট ব্যবস্থা হবে আরো বেশী বিস্তৃত ও সাস্টেনেবল। প্রসঙ্গতঃ বিদেশে ভেটে শিক্ষা দেয় ব্যবসায়ে, প্রশাসনে, বিজ্ঞানে, ইঞ্জিনিয়ারিঙে, হেলথসাইন্সে, ইত্যাদি। তাই মাঝে মাঝে ভেট’কে বলা হয় স্বীকৃত টেকনিক্যাল এডুকেশন ব্যবস্থা যার কদর অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়’কেও ছাড়িয়ে যাই। এ শিক্ষা ব্যবস্থার কদর পশ্চিমাদেশে অপরিসীম যার পরিসর সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা থেকে অষ্ট্রেলিয়া। উল্লেখ্য, শুধু অষ্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়াতেই (১ স্টেটেই) ভেট শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বছরে সরকার খরচ করে ০.৬ বিলিয়ন ডলার (ডিপ্লোমার জন্য মিনিমাম ২ বছর সময় লাগে, ফলে বাজেট লাগে ১.২ মিলিয়ন ডলার)। তাহলে সারা দেশে কত টাকা সরকার খরচ করছে ভকেশনাল ট্রেনিং এ তা সহজেই অনুমেয় কারণ ৮টা স্টেট অষ্ট্রেলিয়াতে!
বাংলাদেশে সঠিক শিক্ষা অবকাঠামো তৈরী করতে অনেকবার দেশে শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং তাদেরকে বিষেশজ্ঞ বানাতে সারা দুনিয়া চষে বেড়াতে হয়েছে প্লেনে চড়ে জনগণের টাকা খরচ করে। দুংখজনক হলেও সত্য যে, কোন কমিশন’ই আজো সঠিক কোন শিক্ষার রূপরেখা জাতির সামনে দাড় করাতে পারেনি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেও। আমরা আসলে বুঝি না যে, অন্যের প্রতিষ্টিত কোন রুপরেখা আমাদের দেশের জন্য সঠিক নাও হতে পারে কারণ শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা নির্ভর করে কোন দেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামো ও ইনভায়ারমেণ্টের উপর! যদি এমন হত যে আমেরিকার শিক্ষা অবকাঠামো ইন্ডিয়াতে উপযুক্ত, তবে অনেক আগেই হাভার্ড এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হত আমাদের সাবকন্টিনেন্টে!
ভেট শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু হয়েছিল অনেক আগেই এবং বেশ ভালভাবেই কাজ করেছিল শুরুর দিকে যা ছড়িয়ে পড়েছিল জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে, সম্ভবতঃ জিয়াউর রহমান ও হুসাইন এরশাদের শাসনামলে (১৯৮০-১৯৯০/৯২)। আমি দেখেছি আমার উপজেলাতে (ঝিনেদা) কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র নক্ষত্রের মত রাতদিন মিটমিট করে জ্বলতে। সব শ্রেণীর মানুষের যাতায়াত ছিল এখানে কারিগরি শিক্ষা নেবার জন্য কারণ এ শিক্ষা বয়সের ছকে বাধা নয়। সে সময়ে স্কুল পালানো অনেক ছেলে-মেয়েই এখানে পড়াশুনা করছিল। এখান থেকে পাস করে কিন্তু অনেকেই তখন চাকুরীও পাচ্ছিল সহজে, যেমন পল্লীবিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডে। আমার অনেক সহপাঠী তখন জেনারেল লাইনে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ভেট থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে আমার আগেই চাকুরী শুরু করে (১৯৮৫-৯০ সালের কথা)। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছি (১৯৯০-৯৬) তখন অনেকেই অফিসার লেভেলের চাকুরে, আয় করছিল ৳১৫-২৫ হাজার।
কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেল ভেট ক্যাম্পাসে গরু-ছাগল চরছে, মানুষের আনা-গুনা কদাচিং। চোখের গোচরে, দিনের আলোয় উজ্জল এ আলোর মিছিল অচিরেই থেমে গেল, অনেকটা জ্বলন্ত আগুনে পানি ঢালার মত। হাটি-হাটি পা-পা করে বাড়ন্ত শিশু হোচট খেল অকালেই! নিভু-নিভু আলোয় এ প্রতিষ্টান যখন হামাগুড়ি দিয়ে নিজের অবস্থান ঠিক রাখার চেষ্টা করছিল, তখন সরকার পরিবর্তন হল – শুরু হল পাকাপাকিভাবে নিধনের ব্যবস্থা। ১৯৯২-৯৬ এর দিকে দেখা গেল আর কেউ এখানে আসছে না শুধু নাইট গার্ডের প্রহরি ছাড়া। কি করুন পরিণতি? এই করুণ পরিণতির অধনীতি দেখা গেল অন্ধকারে অন্যসাজে। ভেট শিক্ষার ক্লাসে ভেজাল মদের ব্যবসা চলতে লাগল দিনের খেয়ালে এবং রাতের আধারে। যারা এতদিন শিক্ষা নিচ্ছিল দিনের আলোয় জীবনে আলো জ্বলাবে বলে, তারাও ভোল পাল্টে রাতের আধারে বড়লোক হবার হাতছানির খপ্পরে পড়ল – শুরু করল ফেন্সিডিলের ব্যবসা। ভেট ক্লাসরুম পর্দাপণ করল ফেন্সিডিলের ডিলার স্টেশনে, অনেকটা এনালগ থেকে ডিজিটালে পরিমার্জন।
অন্যপক্ষে, বিদেশে ভেট শিক্ষা ব্যবস্থা এত বছরে ফুলে-ফলে বেড়ে হয়ে দাড়ায়েছে বটগাছ। বিদেশ থেকে বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা ভেট শিক্ষা নিয়ে এখন দেশে ফিরছে, ইনকাম করছে মাসে ৳৩০-৫০ হাজার। কারন, এখন আর ভেট শিক্ষা শুধু ভেটের ক্যাম্পাসে নেই, উঠে এসেছে আভিজাত্যের আঙ্গিনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নূতন ফর্মে। বলা বাহুল্য, এখন মোটামুটি ৭০-৮০ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই ভেট শিক্ষা ব্যবস্থা (TAFE) চলছে অষ্ট্রেলিয়ায়। নামকরা অনেক TAFE স্কুলও আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের TAFE কে চ্যালেঞ্জ করে যেমন হোমসগ্লেন, NMIT, চিজম, ইত্যাদি। উল্লেখ্য, অষ্ট্রেলিয়ার মনাস বিশ্ববিদ্যালয়েও TAFE চালু হল ২০১১ সাল থেকে যার ৮/১০টা ক্যাম্পাস সারা দুনিয়ায়। এ যাবৎ ভেট শিক্ষায় ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সুইনবার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি ব্যবসা করছিল একচেটিয়া। উল্লেখ্য, এ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের বিরাট অংশ কাভার করে এই ভেট শিক্ষা ব্যবস্থার ইনকাম।
আমাদের দেশেও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব নেই। এখন পাবলিক ও প্রাইভেট মিলে প্রায় ১০০ টার কাছাকাছি বিশ্ববিদ্যালয়। সবাই নূতন নূতন বিষয় খুলছে এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যা প্রশংসার দাবিদার কারণ সেকেলে শিক্ষাব্যবস্থা এখন আর কেউ চায় না! জেনে অবাক হবেন যে, পৃথিবীর অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় এখন পদার্থবিদ্যা বিভাগ তুলে দিচ্ছে, যোগ করছে আর্টস ফ্যাকাল্টিতে ঐচ্ছিক সাবজেক্ট হিসাবে (উদাহরণস্বরূপ, Pennsylvania State University)। ফলে দেশে যেসব নূতন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে তার নূতন সাবজেক্টগুলো ওপেন করা সত্যিই অতি উত্তম। এখন কথা হল, এত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তবে কেউ কেন ভেট শিক্ষাব্যবস্থা চালু করছে না? এটা কেন উপেক্ষিত দেশে যেখান থেকে ইনকাম হতে পারে বছরে কোটি-কোটী টাকা? যেখন থেকে স্কিল্ড ওয়ার্কার তৈরী হতে পারে বছরে কয়েক হাজার যার কর্মসংস্থান সম্ভব দেশের গ্রামে ও শহরে।
ভেট শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু যে ভেটের ক্যাম্পাসে হতে হবে এমন কোন কথা নেই, হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও যার উদাহরণ অষ্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো! তাতে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের নূতন উৎস তৈরী হয় (বাজেটের বিরাট অংশ এখান থেকে যোগান সম্ভব), তেমনি অনেকে এখানে মাষ্টারি টাকা আয় করতে পারবে, ক্ষ্যাপ মারার দরকার হবে না অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্যপক্ষে বিশাল কর্মবিমুখ জনগোষ্টী স্কিল্ড ওয়ার্কারে পরিণত হবে, খুজে পাবে কাজ করার ঠিকানা, ঘুচবে অভাব-অনাটন। এখন যেখানে আনস্কিল্ড ওয়ার্কার বিদেশে রপ্তানি করে দেশের দূরনাম রটছে, স্কিল্ড ওয়ার্কার সেখানে সঠিক কাজের ঠিকানা খুজে পাবে, বন্ধ হবে বিদেশে বাঙ্গালী নাজেহালের চিত্র। আশার কথা হল, এই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে বিরাট বাজেটের কোন দরকার নেই প্রাথমিক স্তরে। যেমন আর্টস ও কমার্স ফ্যাকাল্টি শুরু করতে পারে যে কোন সময়ে তাদের বর্তমান অবকাঠামোতেই। দরকার শুধু মন ও মানসিকতার, সাথে সিলেবাস প্রণয়ন করা এবং কিছু জনবল নিয়োগ দেয়া। সাইন্স ফ্যাকাল্টিও শুরু করতে পারে তাদের বর্তমান অবকাঠামোতেই অন্যের সাথে টেকনিক্যাল সাপোর্ট শেয়ার করে। এখন কথা হল, কোন কোন বিষয় এই ভেট শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তরভুক্ত হবে তা নির্নয় করার জন্য একটা কমিটি তৈরী করা। তারাই নির্ধারণ করবে কি কি বিষয় উন্মুক্ত করা যেতে পারে স্কিল্ড ওয়ার্কার তৈরীর জন্য!
উন্নত দেশে ভেট শিক্ষায় কারা পাঠ নিবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব হাইস্কুল/কলেজের। ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসের স্কোর ও গ্রেডিং (মেধা তালিকা) দেখে শিক্ষকরা স্টুডেন্টদের দু’ভাগে ভাগ করে; সর্টআউট হয়ে যাই কে বিশ্ববিদ্যালয় আর কে ভেট ক্যাম্পাসে যাবে। এখানে কোন হুড়াহড়ি বা মাতামাতি নেই, গুতাগুতি বা দোষাদূষি নেই ছাত্র-ছাত্রীদের ক্যাম্পাস নির্ধারণ নিয়ে – সবাই খুশি যার যার মেধার পরিধি নিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে সবাই ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার হতে ইচ্ছুক, অফিসার ও সেবা দান করার কথা নেই – ভাবটা এমন আমরা সবাই আইনস্টাইনের এলায়েন, শুধু বিজ্ঞান চর্যা করব। এর জন্য অবশ্য আমরাও দায়ী কারন অনেক সময় জোর করে আমাদের বাচ্চাদের ঠেলে দেই বিপদে, ভর্তি করি বিজ্ঞানে – ফলে হাবু-ডুবু খেয়ে মরে শেষ বিকেলে। তাই শিক্ষা অবকাঠামো এমন হওয়া জরুরী যেখানে ছেলে-মেয়েরা খুজে পাবে তাদের সঠিক লাইফ ড্রাইভ এবং পর্যায়ক্রমে বিন্যস্ত যা তৈরী করবে আমাদের দেশের জন্য স্কিল্ড ওয়ার্কার, আন্তনিয়োগ করবে আমাদের দেশের উন্নতিতে।
সুখের কথা যে, ILO বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করে নূতন করে ভেট শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। রুট লেবেলে কিছু কাজ করছে NGO এর মাধ্যমে যা একেবারেই নিন্মমানের। এ প্রসঙ্গে দুয়েকটা প্রতিষ্টানের নাম উল্লেখ করা যাই যেমন Access Toward Livelihood & Welfare Organisation (ড্রেস তৈরী ও এমব্রয়ডারী), BFUW (সুইয়িং ও টেলারিং), YMCA (Secretarial Sciences & Typing) এবং HOPE (কম্পিউটার ফান্ডামেন্টালস, সুইয়িং ও হ্যান্ডিক্রাফটস)। এ সব প্রতিষ্টান যেগুলো নিয়ে কাজ করছে তা আমাদের দেশের জন্য যথেষ্ট নয়, দরকার জাতীয় পর্যায়ে এর শুভ উদ্যোগ। আর এ উদ্যোগে শরীক করতে হবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেখানে তৈরী করা সম্ভব যুগ-উপযোগী স্কিল্ড ওয়ার্কার।