Shubha Jonmodin
শুভ জন্মদিন – কামরুল আহসান খান
ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভে জন্ম হয়েছিল আমাদের প্রিয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’ এর। দেখতে দেখতে ছয় দশক পেরিয়ে গেল। আমি জন্মেছিলাম ১৯৫১ তে, আর ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম ১৯৫২তে। আমার বয়স আর ছাত্র ইউনিয়নের বয়স প্রায় একই। তারুণ্যে ভাস্বর আমার জীবনের উজ্জ্বলতম সময় আমি এই সংগঠনটির সাথে কাটিয়েছি, এর জন্য আমি গর্বিত। ছাত্র ইউনিয়নের কারনেই আমার জীবনের মূল্যবান বহু অর্জন আর মানবিক মূল্যবোধকে আমি সংরক্ষণ ও শানিত করতে পেরেছিলাম।
ছাত্র ইউনিয়নের সাথে আমার সম্পর্কের সুত্রপাত সেই স্কুল জীবন থেকে। জামায়াত ও মুসলিম লীগ ১৯৬৫ সালে প্রচ-ভাবে রবীন্দ্রনাথ বিরোধী প্রচারণা শুরু করে। অপপ্রচারের অংশ হিসেবে তারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে গিয়ে রবীন্দ্র বিরোধী প্রচারপত্র ও বই বিলি করতে শুরু করে। কিন্তু ততদিনে পারিবারিক পরিবেশের কারনে ও বিভিন্ন স্থানে কবিতা আবৃত্তির সুত্রে আমরা রবীন্দ্রনাথকে গণমানুষের, মানবতার কবি হিসেবে জেনেছি। স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে তাই সেই বয়সেই আমরা জামায়াত-মুসলিম লীগের রবীন্দ্রবিরোধী অপপ্রচারের প্রতিবাদ করি, ঢাকার রাজপথে এই ঘৃণ্য তৎপরতার বিরূদ্ধে মিছিল বের করি। পরদিন আমাদের মিছিলের ছবি ফলাও করে দৈনিক সংবাদে ছাপা হয়। আমাদের আন্দোলনের খবর পেয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ ছুটে আসেন। ফলে আমাদের আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে। এর সাথে যুক্ত হয় দীর্ঘদিনের পড়ে থাকা স্কুলের স্থানীয় দাবীদাওয়া সহ ছাত্র আন্দোলনের অন্যান্য ইস্যু। এই পর্যায়ে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। আমরা অনেকেই যোগ দিলাম ছাত্র ইউনিয়নে, তারাও আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য আমাদের নানাভাবে সহযোগিতা করা শুরু করলেন। স্কুলের শিক্ষা ও শহীদ মিনার তৈরী করা নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ১১ দফা দাবীনামা পেশ করা হল। সেলিম ভাই খুব সকালে লিফলেট নিয়ে আমাদের স্কুলে হাজির হলেন। লিফলেট হাতে পেয়েতো আমরা মহা খুশী। আমাদের কথা ও দাবী-দাওয়াগুলো লিফলেট আকারে ছাপা হয়ে এসেছে! আমাদের উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। সাধারন ছাত্রদেরও ব্যাপক সমর্থন পেলাম। বলা যায়, স্কুলের প্রায় সকল ছাত্রই আমাদের সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় এসে দাঁড়ালেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ আমাদের এক সহপাঠীর চাচা, সেই সুবাদে তাঁর কাছে চলে গেলাম। তিনি আন্দোলনের বৃত্তান্ত শুনে সিদ্ধেশরী এলাকার একজন প্রগতিশীল পেশাজীবী জনাব ওয়াজেদ আলি সরকারের কাছে চিঠি লিখে আমাদের পাঠালেন। আমরা সেই ভদ্রলোকের সাথে দেখা করলে আন্দোলনে সাহায্যের জন্য তিনি আমাদের হাতে প্রায় একশ টাকা দিলেন। সেই আমলে একশ টাকা মানে আমাদের আন্দোলনের জন্য অনেক টাকা। এই টাকা দিয়ে আমরা আরো লিফলেট, পোস্টার ছাপালাম।
উনিশশো ষেষট্টি-ষাটষট্টির দিকে আমরা সে সময়ের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যাওয়া শুরু করলাম। আমার সঙ্গে থাকত বন্ধু শাহাদাৎ, বদরুল, মোস্তফা, দাউদ হায়দারসহ আরো অনেকে। সে সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা মহানগরের সম্মেলন হল, আমি সহ-সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। শাহাদাৎও সেই কিমিটিতে ছিল। সম্মেলনে আমাদের পক্ষ থেকে শাহাদাৎ খুব সুন্দর একটা বক্তৃতা দিল। স্কুলের ছাত্র হিসেবে আমাদের উপস্থিতি সম্মেলনে আগত অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল। এরপর এলো প্রাদেশিক সম্মেলন। ছাত্র ইউনিয়নের দ্বিধা-বিভক্তির পর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় সম্মেলন। সেই সম্মেলনে মতিয়া আপা, মানিক ভাই, পঙ্কজ দা, বাচ্চু ভাইসহ অনেকের সাথে পরিচয় হল। তাদের ত্যাগ, বক্তব্য আমাদের দারুনভাবে উদ্বুদ্ধ করল। তখন শুরু হল আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। ছয় দফা দাবীকে পূর্ণতা দিতে ও আন্দোলনের সাথে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করতে আমরা শুরু করলাম ১১ দফার আন্দোলন। এগারো দফা প্রণয়ন ও এর ভিত্তিতে ব্যাপক মোর্চা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিল।আমরা ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), আওয়ামী লীগ ‘এক হও’ ‘এক হও’ মর্মে গগনবিদারী আওয়াজ তুলেছি এবং আন্তরিকভাবে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি, এবং শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহীর পতন ঘটিয়েছি। ঐক্যমোর্চা গড়ার ব্যাপারে অন্য একটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের একাংশেরও অনীহা ছিল। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, শ্রমিক-কৃষকের অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে তারা একটু এড়িয়ে যেত। আমার মনে আছে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে বক্তৃতায় ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালিন সভাপতি ভিয়েতনামের লড়াকু মানুষের স্বপক্ষে সংহতি প্রকাশ করলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আমাদের নাস্তানাবুদ করতে তেড়ে এসেছিল। কিন্তু আমরা সেদিন আমার্দে অবস্থান থেকে পিছু হটিনি। পরে তারা অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছে, আন্দোলনে বিশেষ করে স্বাধীনতার আন্দোলনে বহির্শক্তির সমর্থন কতটা প্রয়োজন। গণমানুষের প্রাণের দাবীগুলো নিয়ে সেদিন যদি ১১ দফার আন্দোলন না হত, তাহলে এমন গণজাগরণ আমরা তৈরী করত পারতাম না, আর স্বৈরাচারেরও এত দ্রুত পতন হত না।
আমাদের প্রাণের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরতন্ত্রের বিরূদ্ধে সবসময় আপোষহীন থেকেছে। ষাটের দশকের বিভিন্ন সময়ে আমরা কঠোরভাবে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, বাঙালি- অবাঙালি দাঙ্গাসহ সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি। আমর তখন বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গিয়ে পাহাড়া দিতাম এবং এর বিরূদ্ধে জনমত সংগঠিত করতাম। জামায়াত-শিবিরের অপতৎপরতার বিরূদ্ধেও আমরা ছিলাম আপোষহীন। আমরা সাহসের সাথে এইসব অপশক্তির মোকাবেলা করেছি।
শুরু থেকেই আমি দেখেছি ছাত্র ইউনিয়নে নারী সদস্যদের সংখ্যা ছিল উল্লেখ করার মত। এই নিয়ে অনেকে আমাদের টিপ্পনি কাটলেও আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামে নারীদের সম্পৃক্ত করতে পেরে আমরা গর্ববোধ করতাম। তখন নারী আন্দোলনের নেতৃত্বের পুরোভাগেই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মেয়েরা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও ছাত্র ইউনিয়ন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। পূর্ব যোগাযোগের কারনেই সেদিন ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগেই ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা ডামি রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছিল। ছাত্র ইউনিয়নের প্রায় সকল সদস্যই সেদিন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেছিল। আমাদের সাহস, ত্যাগ-তিতিক্ষা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সাথে আজো মিশে আছে।
স্কুল জীবনে শুরু করা ছাত্র ইউনিয়নের সাথে আমার সম্পর্কটা আত্মার। এক পর্যায়ে আমি এই সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলাম। আজো আমি সেইসব উজ্জ্বল দিনের স্মৃতি বয়ে বেড়াই। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হবে। মানুষের ঘরে ঘরে স্বাধীনতার সুফল পৌছে দিতে হবে। এর জন্য আমাদের নতুন করে আয়োজন শুরু করতে হবে, সংঘটিত হতে হবে। আগামী দিনের সেই লড়াইয়ে ছাত্র ইউনিয়ন সামনের কাতারে থেকেই গণ মানুষের মুক্তির স্বপক্ষে লড়াই করবে বলেই আমার বিশ্বাস। আজো অন্তরের গহীনে আমি বিশ্বাস করি, মেহনতী মানুষের জয় অনিবার্য।