পনরই আগস্টের ঘটনা কি একটি সামরিক অভ্যুত্থান ছিলো? – আবদুল গাফফার চৌধুরী
নভেম্বর ২৪, ২০০৯ | উনিশে নভেম্বর তারিখে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। বারোজন আসামীর (একজন মৃত) জন্য হাইকোর্ট বেঞ্চের আগের দেওয়া প্রাণ দণ্ডাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বহাল রেখেছে। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর পরে হলেও জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হলো এবং অপরাধীরা শাস্তি পেতে যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের দলমত নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছেই স্বস্তি ও সন্তোষের বিষয়। দেশের মিডিয়ার আলোচনা এবং বেতার ও টিভির টকশো গুলোতেও এই স্বস্তি ও সন্তোষের ভাব লক্ষ্য করা গেছে।
উনিশ নভেম্বর দুপুরে (লন্ডণ সময়) বিবিসি বেতারের বাংলা বিভাগও হত্যা মামলার এই রায় সম্পর্কে একটি আলোচনা প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাতে আমিও অংশ গ্রহণ করেছিলাম। এই আলোচনায় ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপি ঘরানার এক প্রবীনবুদ্ধিজীবীও। তিনি খুব কৌশলে এই হত্যাকান্ডের চরিত্র এবং তার বিচার সম্পর্কেও বিতর্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন।
আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে, একটি মুক্তি সংগ্রামের নায়ক এবং একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রধানকে সপরিবারে নৃশংস হত্যার বিচার বন্ধ রাখার জন্য প্রথমে ঘাতকদের জন্য ইমডেনটিটি অধ্যাদেশ জারি, তার পর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এই বিচার শুরু হলে তা বন্ধ রাখার চেষ্টা আরো পরে বিচারকদের আপিল শুনানিতে বিব্রত বোধ করা ইত্যাদি এতো কিছুর পরেও দেশের সাধারণ আইনে, সাধারণ বিচার ব্যবস্থায় বিষয়টি যখন হলো এবং একটি নৃশংস হত্যাকান্ডের অপরাধীরা যখন দেশের সকল মহলের কাম্য শাস্তি পেতে যাচ্ছে, তখনো এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে, হত্যাকারীদের সম্পর্কে কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বিভ্রান্তি সৃষ্টির ‘নৈতিক বল’ খুঁজে পান কেমন করে ?
বিবিসি’র উনিশে নভেম্বরের আলোচনায় ঢাকা থেকে যে প্রবীন বুদ্ধিজীবী অংশ গ্রহণ করেছিলেন তার (এবং তার সমমনা ব্যক্তিদের) মতে, “১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডটি কোনো চক্রান্তপ্রসূত হত্যাকাণ্ড নয়। এছিলো সাময়িক অভ্যুত্থান”। তার বক্তব্যের নির্গলিতার্থ হলো, সকল সামরিক অভ্যুত্থানের কোনো বিচার হয়না এবং এই অভ্যুত্থানে যে হত্যাকাণ্ড ঘটে তার জন্য ব্যক্তি বিশেষ বা ব্যক্তিগতভাবে কোনো গোষ্ঠি দায়ী নয়। ইতিপূর্বে বিএনপি ঘরানার আরো কেউ কেউ বলেছেন, ১৫ আগস্টের হত্যার বিচার সামরিক আইনে হওয়া উচিত ছিলো। অর্থাৎ বর্তমান বিচার পদ্ধতির বৈধতা সম্পর্কে তারা প্রশ্ন তুলতে চান।
বিবিসি’র উনিশে নভেম্বরের আলোচনায় ঢাকার বুদ্ধিজীবী একটি পরস্পর বিরোধী কথা বলেছেন। তিনি একদিকে বলেছেন ১৫ আগস্টের ঘটনা একটি সামরিক অভ্যুত্থান, অন্যদিকে প্রমান করার চেষ্টা করেছেন- আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের একাংশই এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। এই একাংশের নেতা খোন্দকার মোশতাকই এই হত্যা চক্রান্তের মূল নায়ক এবং হত্যাকাণ্ডের পর তার নেতৃত্বে মুজিব সরকারের সাবেক সদস্যদের নিয়েই নতুন সরকার গঠিত হয়েছিল। আমার প্রশ্ন- সামরিক অভ্যুত্থানে কি অসামরিক নেতৃত্ব থাকে এবং অসামরিক সরকার গঠিত হয়?
পনেরই আগস্টের ঘটনার পর পর গত চৌত্রিশ বছর ধরে ঘটনাটি সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। বিবিসি’র উনিশে নভেম্বরের আলোচনায় ঢাকা থেকে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী যা বলেছেন, তারও জবাব একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বহুবার দিয়েছেন। তারপরেও সেই হত্যা মামলার আপিল শুনানির রায়কেও কেন্দ্র করে নতুন করে পুরনো কাসুন্দি ঘাটার চেষ্টা, বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রথম কথা, বাংলাদেশে পনেরই আগস্টের ঘটনা যদি সামরিক অভ্যুত্থানই হবে তাহলে এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রধান সেনাপতি, বিমান, নৌ ও স্থল বাহিনীর প্রধানদের সংশ্লিষ্টতা কোথায় ? পনেরই আগস্টের হত্যা মামলার আপিল শুনানিতে আদালত বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের পর প্রধান সেনাপতি ভীরুতার পরিচয় দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি হত্যা চত্রান্তে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু এই হত্যাকারীদের প্রতিরোধ এবং দেশের প্রেসিডেন্টের জীবন রক্ষার কাজে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন এবং ভীরুতার পরিচয় দিয়েছেন। আদালতের এই মন্তব্য তাহলে সেনাবাহিনীর স্থল, নৌ, বিমান বাহিনীর তখনকার প্রধানসহ খালেদ মোশাররফ, সফায়াত জামিল প্রমুখ সেনাবাহিনীর তদানিন্তন আরও অনেক কর্মকর্তা সম্পর্কে সত্য। তারা তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানকে সপরিবারে হত্যার চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবে এই চক্রান্ত রোধে ব্যর্থতা অথবা ভীরুতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা এই হত্যাকাণ্ডের বেনিফিসিয়ারিও হননি।
এখানেই প্রশ্ন, সামরিক অভ্যুত্থান দ্বারা প্রধান সেনাপতিসহ তিন বাহিনীর প্রধানই ক্ষমতায় বসতে পারলেন না এটা কেমন কথা ? এটা কি ধরণের সেনা অভ্যুত্থান ? এই অভ্যুত্থানের প্রধান সেনাপতি ও বিমান বাহিনী প্রধানকেও রাষ্ট্রদূত করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই অভ্যুত্থানের একমাত্র বেনিফিসিয়ারি হন ডেপুটি সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাকে সামরিক বাহিনীর চাকুরি থেকে অপসারণ করে রাষ্ট্রদূতের চাকুরি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়নি। তাকে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল। তিনি ধীরে ধীরে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা না করে তাদের বিচারের পথ রুদ্ধ করার জন্য সংবিধানে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ যুক্ত করেন এবং ঘাতকদের অধিকাংশকেই সরকারি উচ্চপদে নিয়োগ দ্বারা পুরস্কৃত করেন।
তাহলে এটা কি ধরণের সামরিক অভ্যুত্থান? পৃথিবীরে সব দেশেই সামরিক অভ্যুত্থানে সেনা প্রধানেরা ক্ষমতায় বসেন। পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানে সেনা প্রধান আইয়ুব ক্ষমতায় বসেছিলেন। তুরস্কে মেন্দারেসের রাজনৈতিক সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে সেনাপ্রধান জেনারেল গার্সেল তার সহকর্মীদেরসহ ক্ষমতায় বসেছিলেন। চিলিতে আলেন্দে সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রেসিডেন্ট পদ দখল করেছিলেন জেনারেল পিনোচেট। বাংলাদেশেও একধরনের সামরিক অভ্যুত্থান বলা চলে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলকে। তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থনে ও সহায়তায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে প্রথমে একজন শিখন্ডি বিচারপতিকে কিছুদিন ওই পদে রেখে শেষে নিজেই রাষ্ট্রপতি পদে বসেন।
এই সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনাকে পাশাপাশি রেখে বিচার করলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনাকে কি সামরিক অভ্যুত্থান বলা চলে ? যেখানে সামরিক বাহিনীর প্রধানসহ কোনো বাহিনী প্রধান এই অভ্যুত্থানে জড়িত ছিলেন না, এমন কি তাদের অধীনস্থ বাহিনী গুলোও নয়। তারা কেউ এর বেনিফিসিয়ারিও হননি। একমাত্র হয়েছেন তৎকালীন ডেপুটি সেনা প্রধান জিয়াউর রহমান।
সন্দেহ নেই, ১৫ আগস্টের ঘটনা ছিলো চত্রান্তকারীদের সুপরিকল্পিত হত্যা চক্রান্ত। তাতে বিদেশি চক্রান্তকারীরাও যুক্ত ছিলো এবং এই চক্রান্ত্রের আসল লক্ষ্য ছিলো সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকার পরিবর্তন নয়; কারণ, সামরিক বাহিনীর সকল অংশ এবং সকল প্রধানের সমর্থন চক্রান্তকারীরা পেতোনা। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল নায়কদের হত্যা এবং স্বাধীনতার মৌলিক চরিত্রকে ধ্বংস করে একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা না গেলেও তাকে পাকিস্তানের ক্লায়েন্ট স্টেটে পরিণত করা।
এই ব্যাপারে স্বার্থ ও উদ্দেশ্যগত একটা মৈত্রী প্রবাসী মুজিব সরকারের আগোচরে গড়ে উঠেছিল খোন্দকার মোস্তাকের রাজনৈতিক গ্র“প এবং জিয়াউর রহমানের একটি ক্ষুদ্র সামরিক ক্লিকের মধ্যে। দু’জনের মধ্যেই ছিলো অতি উচ্চাকাঙ্খা। জিয়াউর রহমানতো কালুর ঘাটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করতে গিয়ে রেডিওর মাইক হাতে পেয়েই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন এবং মোশতাকও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অধীনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ পেয়ে সন্তষ্ট ছিলেন না। মোশতাক এবং জিয়াউর রহমান দু’জনের স্ট্রং পিন্ডি এবং ওয়াশিংটন কানেকশন ছিলো। পনেরই আগস্টের চক্রান্তের সূত্রপাত বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন হওয়ার আগেই মুজিব নগরে। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে তাজউদ্দীন সরকার মোশতাক ও জিয়াচক্রের ষড়যন্ত্রের কিছুটা আভাস পেয়েই জিয়াউর রহমানকে সেক্টর কমান্ডার পদ থেকে অপসারণ এবং তার জেড ফোর্সকে নিস্ক্রিয় করে ফেলেন। অন্য দিকে খোন্দকার মোশতাক আহমদ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদ থেকে অঘোষিত ভাবে অপসারিত হন। তার স্থলাভিষিক্ত হন আবদুস সামাদ আজাদ।
সুতরাং ইতিহাসের বিচারে এবং বাস্তবতার নিরিখে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শেষ রাতের বর্বর হত্যাকান্ডকে কিছুতেই সামরিক অভ্যুত্থান বলা চলেনা। সামরিক অভ্যুত্থান বলে তাতে নেতৃত্ব দিতেন সেনা প্রধানসহ বিভিন্ন বাহিনীর সকল প্রধান এবং ইনফেন্ট্রি, আর্টিলারিসহ সেনা বাহিনীর সকল অংশ। সেনাপ্রধানদের অনুপস্থিতিতে কয়েকজন কর্নেল ও চাকুরিচ্যুত মেজর কয়েকটি গোলাবারুদহীন ট্যাঙ্ক নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনের দিকে এগুতো না। ঘটনাটি আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়ার পরও সেনা প্রধানেরা এবং মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্রচালনায় ট্রেনিং প্রাপ্ত আওয়ামী লীগের যুব নেতারা সাহসী হয়ে এই ঘাতকদের প্রতিরোধে এগিয়ে এলে ঘাতকদের পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হতো।
এই হত্যা চক্রান্তের পরিকল্পনাটি স্বাধীনতার পরপরই মুজিব নগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়েছিলো। মোশতাক চক্রে ফারুক, ডালিম, হুদা, রশিদ প্রমুখ এক জোটে। অন্যদিকে জে. জিয়া সেনাবাহিনীকে তার নিয়ন্ত্রনে নিয়ে কোনো সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে পারবেন না জেনে ফারুক, রশিদ, ডালিমদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ গড়ে তোলেন। অন্যদিকে নবগঠিত জাসদের ইনফেনটাইল রেভুলশনারি এডভেঞ্চারেও তিনি উসকানি দিতে থাকেন। জিয়াউর রহমানের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে পরে নির্মমভাবে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দেন কর্নেল (অব.) তাহের। তিনি দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি এবং গণবাহিনী গঠনের লক্ষ্যে একটি সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং এই কাজে জিয়াউর রহমান তাকে সাহায্য করবেন ভেবেছিলেন। জিয়া তাকে সেই আশ্বাসই দিয়েছিলেন এবং তাহের তাকে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করেছিলেন। জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাস করার ফল কর্নেল (অব.) তাহের হাতে হাতে পেয়েছিলেন। তার বিপ্লব ব্যর্থ হয় এবং জিয়ার নির্দেশে ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচারে তাকে প্রাণ দিতে হয়।
১৯৭৫ সালে আগস্ট মাসে বাংলাদেশে কোনো সামরিক অভ্যুত্থানই ঘটেনি। যা হয়েছিল, তাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের একটি ধারাবাহিকতার সাফল্য বলা চলে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক চক্রগুলোও এই ষড়যন্ত্রে এসে যোগ দিয়েছিলো। এই চক্রান্তে বুদ্ধির খেলায় জিয়াউর রহমানের কাছে মোশতাক হেরে যান। বুদ্ধিমান বানর যেমন নিজে দই খেয়ে ছাগলের দাড়িতে হাত মুছে রেখে তাকে গৃহস্থের হাতে মার খাইয়েছিলো, তেমনি জিয়াউর রহমান ১৫ আগস্টের সব দায় দায়িত্ব মোশতাক ও তার ফারুক-ডালিম গ্যাঙের মাথায় চাপিয়ে দিয়ে তাদের কিছুদিন বঙ্গভবনে রাজা রাজা রাজা খেলতে দিয়ে পরে দড়ি গুটিয়ে নিয়েছেন এবং দীর্ঘ পরিকল্পনার সাফল্য হিসেবে নিজে মসনদ দখল করেছেন।
মোশতাক আহমদকে বঙ্গভবনে তিনমাসের নবাবি করতে দিয়ে এবং আওয়ামী লীগের ভীত হতভম্ব একদল মন্ত্রীকে বন্দুকের নলের মুখে তার মন্ত্রী হতে বাধ্য করার মূলে চক্রান্তকারীদের আসল উদ্দেশ্য ছিলো ১৫ তারিখের হত্যাকান্ডটি আওয়ামী লীগই ঘটিয়েছে এবং দেশে মুজিববিহীন আওয়ামী সরকারই ক্ষমতায় রয়েছে এই প্রচারটাকে বিশ্বাসযোগ্য করা এবং এই ধুম্রজালের সুযোগে সময় নিয়ে শক্ত অবস্থানে দাড়িয়ে ক্ষমতার মসনদে বসা। তারা সেটাই করেছেন।
আওয়ামী লীগের চার প্রধান নেতা তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান, মনসুর আলি, যারা চক্রান্তকারীদের পাশার দান উল্টে দিতে পারতেন, তাদের জেলে বন্দি করে হত্যা করা হয়। ১৯ নভেম্বর বিবিসি’র আলোচনায় ঢাকার বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ১৫ আগস্টের ঘটনায় দায় দায়িত্ব আওয়ামী লীগের উপর চাপানোর জন্য যেসব কথা বলেছেন, তা আমার উপরের বিশ্লেষণটাই সত্য প্রমাণ করে। উনিশে নভেম্বরের আলোচনাতে ঢাকার বুদ্ধিজীবীর এই বক্তব্যই ছিলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকান্ডের পর আজকের বিএনপি’র পূর্বশুরীদের অবিরাম প্রচারণা।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে অপসারিত জুনিয়ার অফিসার এবং কেউ কেউ তখনো চাকুরিতে ছিলেন। জাতির জনক এবং রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করতে গিয়ে এরা মুষ্টিমেয় সেনা সদস্যের সমর্থন ও সহায়তা পেয়েছে, কিন্তু বাকি চক্রান্তটাই ছিলো গোপন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের। এর বিচার কি কারণে সামরিক আইনে করতে হবে ? দেশের প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থা কি তার জন্য যথেষ্ট নয় ? চিলিতে যে সেনা প্রধান সত্য সত্যই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, ক্ষমতাচ্যুতির পর তারতো সামরিক আইনে বিচার হয়নি, হয়েছে দেশের প্রচলিত আইনে গঠিত বিশেষ ট্রাইবুনালে।
দক্ষিণ কোরিয়ার যে সেনা প্রধান সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল ও নানা অভিযোগে বিচারে সোপর্দ হয়ে দন্ডিত হয়েছিলেন, তাকেও সামরিক আদালতে বিচার করা হয়নি। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার কেন সামরিক আইনে বা সামরিক আদালতে হতে হবে ? চল্লিশের দশকে নাৎসি নেতা ও সমর নেতাদের বিচারের জন্য গঠিত নুরেমবার্গ বিচার আদালত কি সামরিক আদালত ছিলো ? বাংলাদেশে এসব প্রশ্নের জবাব বিএনপি নেতারা এবং তাদের অনুগ্রহভোজী বুদ্ধিজীবীরাই ভালো জানেন। বুঝহ লোক যে জানহ সন্ধান। লন্ডন। ২৩ নভেম্বর সোমবার ॥ ২০০৯।
Link requested by Anim Rahman | original source