বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮
আমাদের সময় ছিল মোহামেডান – আবাহনী। কত দিনরাত গেছে শুধু নিজ ক্লাবের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে। ফুটবল নিয়ে ইটা ইটি, মারামারি, ক্লাবের পতাকা নিয়ে জ্বালাও পোড়াও, সালাহ উদ্দিন ভালো না এনায়েত ভালো, কে কতবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, কার জালে কে কতবার বল প্রবেশ (আসলে অন্য শব্দ ব্যাবহার করেছি) করিয়েছে, আরও কত কি। ধীরে ধীরে এই দ্বন্দ্ব ক্রিকেট, হকি, দাবা, ব্যাডমিন্টন – সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সিকি শতাব্দী আগে দেশ ছাড়ার সময়েও এই অবস্থা দেখে এসেছি, নিজেও এইসবের প্রথম সারির একজন কর্মী ছিলাম।
বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে সীমিত মাতামাতি শুরু হয় ১৯৮২ থেকে, কারন প্রথমবারের মত সবেধন নীলমণি বিটিভি স্পেন থেকে সরাসরি খেলা সম্প্রচার করে। এইটার রাজনৈতিক কারন আছে । মাত্র কয় মাস আগে এরশাদ বন্দুক দেখিয়ে বুড়া সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে সারা দেশে সামরিক আইন অর্থাৎ জংলী আইন চালু করেছে। জনগণকে ঘরে আটকে রাখার চমৎকার কৌশল যদিও তখন টিভি সহজ লভ্য হয়ে উঠে নাই। লম্বা বরাক বাঁশের মাথায় বা বাড়ীর ছাদে এন্টেনা দেখে বুঝা যেত ওই বাড়িতে টিভি আছে। ধীরে ধীরে টিভি অনেকটা সহজলভ্য হয়ে আসে। সাদা কালো টিভি ১৯৮৬ তে টিভি শহরের লাওঞ্জ ছাড়িয়ে গ্রামে গঞ্জে প্রবেশ করে, কারন রঙ্গিন টিভি শহরের লাউঞ্জে আসা শুরু করে । খেলাধুলা সম্প্রচারের স্পন্সরিং করে যে নিজ পণ্যের বিশাল প্রসার ঘটানো যায়, বাঙালি বেনিয়ারা তা বুঝা শুরু করে। প্রতি শনিবার আর সোমবার রাতে ইংলিশ লীগের রেকর্ড করা খেলা দেখাত। বাঙালি লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, টটেনহ্যাম এর খেলা দেখা শুরু করে। লন টেনিস, একদিনের ক্রিকেট, শারজাহর দুই নম্বরি ক্রিকেট- সব এরশাদের সময়ে শুরু হয়- উদ্দেশ্য একটাই ছিল- পাবলিককে ওইসবে বুদ রেখে নিশ্চিন্তে অবৈধ ভাবে দেশ চালানো। বানিজ্য কেন্দ্রিক পত্র পত্রিকা আর বিভিন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন- বিচিত্রা, রোববার, যায় যায় দিন, খেলাধুলার প্রতিবেদন ফুটবল ক্রেজ অনেক বাড়িয়ে দেয়।
১৯৭৪ এর কথা জানি না, অনেক ছোট আমি, আর মাত্র বাংলাদেশে এসেছি। ১৯৭৮ এ আর্জেন্টিনা আর হল্যান্ডের মধ্যকার ফাইনাল খেলা বিটিভি দুইদিন পর দেখিয়েছিল। মনে আছে ৯০ মিনিট ১-১ গোলে শেষ হলে অতিরিক্ত সময়ে লম্বা চুলউয়ালা মারিও ক্যাম্পেস (জার্সি -১০) ও বারতনি (জার্সি -৪) দুই গোল করে আর্জেন্টিনাকে প্রথম বারের মত বিশ্বকাপ জয়ী করে। প্রথম গোলটিও মারিও করেছিল। ১৯৮২ তে ফুটবলে মেরুকরন শুরু হয়; আর্জেন্টিনা- ব্রাজিল। দেখা গেল একটু বয়স্করা পেলের কারনে তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের সমর্থক- আর তরুণরা ম্যারাডনা কেন্দ্রিক আর্জেন্টিনার । ১৯৮২ তে জিকো, সক্রেটিস, স্যান্তানার দল চ্যাম্পিয়ন হবেই- এমন একটা ধারনা ছিল। তার উপর আর্জেন্টিনাকে দ্বিতীয় পর্বে ৩-১ গোলে হারালে ধারনা আরও পাকাপোক্ত হয়। কিন্তু কোন র্যাঙ্কিঙ্গে না থাকা ইটালির পাওলো রসি তার হ্যাট্রিক দিয়ে ব্রাজিলকে ৩-২ গোলে, এমনকি ফাইনালে জার্মানিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়। ট্যাক্স ফাঁকির কারনে জেল খাটা আসামি রসিকে জেল থেকে আগাম বের করে ইটালি দলে খেলানো হয়েছিলো। রসি সর্বাধিক গোলদাতা হিসেবে গোল্ডেন সু পেয়েছিল। কিন্তু ম্যারাডনাকে মানুষ ভুলে নাই।
১৯৮৬ তে আবাহনী- মোহামেডানের মত আর্জেন্টিনা–ব্রাজিল দ্বৈরথ পুরো দমে শুরু হল। ম্যারাডনা, বাতিস্তা, বুরুচাগা ছাড়া আর কারও নাম কেউ তেমন জানে না, কিন্তু ব্রাজিল দলের সক্রেতিস, জিকো, কারেকা, সিজার সহ সব প্লেয়ারের নাম পত্র পত্রিকা, খবরের কাগজে, এমনকি টিভিতেও। এবারে ব্রাজিলকে ঠেকায় কে? কিন্তু বাস্তবে ১৯৮৬ সাল ছিল ম্যারাডনার আর্জেন্টিনার। ম্যারাডনা অধিনায়কও বটে। শুধু মাত্র ইটালির সাথে প্রাথমিক পর্বে ১-১ গোলে ড্র করে। কুয়ারটার ফাইনালে সেই ‘ঈশ্বরের হাত’ এবং শতাব্দির সেরা গোল করে আরও বিখ্যাত হয়ে গেল। সেমি ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে একাই দুই গোল করে। ফাইনালে জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় বারের মত বিশ্ব কাপ জয়ী হয়। এক ঐতিহাসিক খেলায় ফ্রান্স ব্রাজিলকে টাই ব্রেকারে হারিয়ে সেমিফানালে জার্মানির কাছে হেরে যায়। মিশেল প্লাতিনি ফ্রান্সের ফুটবলের রাজপুত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।
তারপর টিভির আরও সহজ লভ্যতা, রঙ্গিন টিভির দাম কমে আসা, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, আন্তর্জাতিক খেলার সম্প্রচার… নিয়ে আসে আর্জেন্টিনার কানিজিয়া ও অরতেগা, ব্রাজিলের রমারিও এবং রোনাল্ডো- সাথে আরও অনেক প্লেয়ারের গল্প, সাথে থাকতো বিভিন্ন দলের মূল্যায়ন। আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের পরপর কয়টা বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা- ধীরে ধীরে দেশের ফুটবল ভক্তদের দুই শিবিরে মেরুকরন ঘটে। বাংলাদেশ যদি বিশ্বকাপে খেলতে পারত, তাহলে এই ভাগাভাগি হতো না। যে কোন খেলাতে নিজের কোন প্রিয় দল বা প্লেয়ার না খেললেও, নিজের অজান্তেই একটা দল বা প্লেয়ারকে সমর্থন দিতে শুরু করে।
বাঙালি প্রধানতঃ দুই ভাগে বিভিক্ত হয়ে থাকতে ভালবাসে। রাজনীতি, সাহিত্য, মহান শিক্ষক বৃন্দ, সিনেমা, শিল্পকলা, দেশে প্রবাসে এমনকি কি স্থানীয় ছোটখাটো সংগঠন, মসজিদ কমিটি, ইস্কুল কমিটি, ল্যাট্রিন কমিটি- সর্বত্র কম করে হলেও দুইটা দল আছে। সাংবাদিক ভাইদের যে কতগুলো দল আর স্তর আছে- উনারা নিজেরাও জানেন না। রাজনীতির কথা বাদ দেই- ওইটা অনেক বড় ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, শাবানা-ববিতা, কুমিল্লা-নোয়াখালী, উত্তর বঙ্গ- দক্ষিন বঙ্গ, সাদা দল – নীল দল, সুবর্না-চম্পা, আবাহনী- মোহামেডান, থাক এই পর্যন্ত। তাহলে খেলাধুলা এর বাইরে থাকবে কেন?
এখন ক্রিকেট সব কিছু নিয়ে নিয়েছে। তার উপর ইলেকট্রনিক মিডিয়া, টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট এর সুবাদে বাইরের খেলাধুলা বিশেষ করে ফুটবল দেখে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে, তাই সময়ের সাথে সাথে মোহামেডান – আবাহনী দ্বৈরথ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মানুষ উন্নত বিকল্প পেয়ে গেছে, তার স্বাদ নিতে পারছে যেখানে নিজ দেশের উপাদান গৌণ। দেশের ক্রিকেট যদি তার বর্তমান উন্নতি ধরে রাখতে না পারে, মানুষ কিন্তু আবারও ভারত – পাকিস্তান দ্বৈরথে ফেরত যাবে।
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে দুই দল, তিন দল, চার দল সমর্থক হোক না, অসুবিধা কি! এতো ঝড় বৃষ্টি, গরম, জানজট, ব্যাংক চুরি, ভাঙ্গা রাস্তাঘাট, রাস্তায় হাঁটু পানি… ইত্যাদির মাঝে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেসি, নেইমার, পগবা যদি নাটোরের বনলতা সেনের মত দুই দণ্ড শান্তি দেয়- তবে ক্ষতি কি?
Related Articles
উলালা!! দিল মে মেরা পাকিস্তান, মেরা হিন্দুস্তান
ধরুন, আপনি খেলাধুলার প্রতি মহা অনুরক্ত। আপনার নিজের দেশটি খেলছে না। তখন কি আপনি সুশীল সমাজের সদস্য হয়ে যাবেন? ভাবছেন,
শহীদ বুদ্ধিজীবিদের স্মরণ
শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তার স্থানীয় দোসর- রাজাকার, আলবদর, আলশামস এর নৃশংসতার বর্ণনা পড়ে এবং শুনে মন যত
“Saree diplomacy” between Bangladesh and India
On 25th June, India’s Minister for External Affairs Ms. Sushma Swaraj visited Dhaka for 38 hours. Ms. Swaraj stated that