জীবনানন্দের প্রেতাত্মা

জীবনানন্দের প্রেতাত্মা

গায়ের রাস্তা ধরে গরুর গাড়ি চলেছে তার একঘেয়ে ক্যা-কু শব্দ করে। গাড়িতে হাসিনা খাতুন আর তিন সন্তান। বড় আর মেজো দুজন পিঠাপিঠি তাই তারা গাড়ির উপর থেকে উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে চারপাশটা। গ্রামের রাস্তার দুপাশে ফুটে থাকা নাম না জানা অসংখ্য ফুলে তাদের শিশু মনে আনন্দ দিয়ে যায়।

নানা বাড়িতে গেলেই মায়েরা সব বোন মিলে পাশের নদীতে দলবেধে গোসল করতে যায়। আর বাচ্চাদেরকে কোলে করে নিয়ে নদীর পারে বসিয়ে রাখে। নদীতে গোসল করার সময় অনেক ধরনের খেলায় খালারা মেতে উঠেন আরা অপার বিস্ময় নিয়ে নদীর পাশে বসে থাকা বালক বালিকারা সেটা দেখে। কলমি লতার বা হেলেঞ্চার ডাটা পানিতে ফেলে সবাই মিলে সেটাকে ঢেউ দিয়ে হারিয়ে ফেলা। এরপর যে সবার আগে সেটা খুজে পেয়ে একটা ডুব দিতে পারবে তার এক পয়েন্ট। কিন্তু ডুব দেয়ার আগেই যদি কেউ তার মাথা ছুয়ে ফেলে তাহলে সে কোন পয়েন্ট পাবে না। গোসলের শেষের দিকে নদীর আঠাল (এটেল) মাটি দিয়ে চুল পরিষ্কার ব্যাপারটা খুবই অবাক করতো শিশুদের।

নদীর পানি বেড়ে গিয়ে একসময় কাছাকাছি সমতল ডুবিয়ে দিয়ে বন্যার আকারে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। প্রথমে নিচু জায়গাগুলো প্লাবিত করে তারপর আসতে আসতে উচু জায়াগাগুলোও গ্রাস করতে শুরু করে। মানুষ নিজ উদ্যোগে নিজেদের ঘরবাড়ির ভিটে উঁচু করে নেয় তাই দিনে দিনে রাস্তাটা নিচু হয়ে যায়। রাস্তা দিয়ে বন্যার পানি বয়ে চলেছে। হাসান তার ফুপাতো চাচা (আব্বার ফুপুর ছেলে) কুদ্দুসের সাথে মিষ্টি কুমড়োর ফুলের ভিতরের অংশ দিয়ে এক মজার খেলায় মেতে উঠেছে। কুদ্দুস চাচা পানির গতির ভাটির দিকে আর হাসান উজানের দিকে। হাসান কুমড়োর ফুলের অংশটা পানিতে ছেড়ে দেয়। সেটা পানির সাথে বয়ে চলে একসময় কুদ্দুস চাচার কাছে হাজির হয় তখন কুদ্দুস চাচা সেটাকে পানি থেকে তুলে হাসানের দিকে ছুড়ে মারে। হাসান সেটা আবার পানিতে ভাসিয়ে দেয়।

বন্যার পানিতে গোসল করতে যেয়ে হাসান অবাক বিস্ময়ে দেখে লালচে লালচে কিসের যেন দলা ভেসে যাচ্ছে। কাছে দেখে অসংখ্য লাল পিপড়া একসাথে হয়ে এই দলা তৈরি করেছে। পরে বড়দের কাছ থেকে জেনেছিল বন্যা আসলেই পিপড়ারা এইভাবে জোটবদ্ধ হয়ে ভেসে চলে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা কোন স্থলের সাথে আটকে যায়। বন্যার পানিতে প্রায় সব জায়গায় ডুবে গিয়েছে ভিটেবাড়ির বাইরে সামান্য যে জায়গাটুকু জেগে থাকে সেখানে দুনিয়ার সকল ইদুর এসে বাসা তৈরি করেছে। বাড়ির কুকুর সেই ইদুর ধরার জন্য গর্তের বাইরে শিকারি ভঙ্গিতে বসে আছে। হাসান যেয়ে গর্তের আড়ালে দাঁড়িয়ে অনায়াসেই একটু ধাড়ি সাইজের ইদুর ধরে ফেলে। তারপর সেটা নিয়ে কুকুরটার সাথে এক মজার খেলায় মেতে উটে। সে তার ইদুর ধরে রাখা হাতটা একটু নিচু করে আর কুকুরটা সেটা লাফ দিয়ে ধরার চেষ্টা করে। কুকুরটা একসময় সফলকাম হয়। কিন্তু হাসানের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে বসে যায় কুকুরের দাঁতের দাগ। যেটা বেশ কিছুদিন লুকিয়ে রাখার পর সবাই জেনে যায় যার ফলশ্রুতিতে হাসানের নাভির চারপাশে নিতে হয় চোদ্দটা ইনজেকশন।

নদীতে নতুন চর জেগেছে। আগের ভিটের মাটি জেগে উঠেছে যেটা নদী বেশ ক বছর আগে গলাধকরণ করেছিল। গ্রামের সবাই এক মৌসুমের জন্য অস্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি বানানো শুরু করেছে চরে এবং চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জাম নৌকাতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সর্বশেষে হালচাষের জন্য গরু নিয়ে যাবে বাড়ির রাখাল। বাড়ি শিশুরা বাইনা ধরেছে তারাও যাবে চরে। কিন্তু সবাই আবদার মঞ্জুর করা হচ্ছে না। হাসান একটু বয়সে বড় আবার বংশের বড় ছেলেও, তাই তার আবদারটা রক্ষা করা হল। নদী পার হওয়ার সময় রাখালের শিখিয়ে দেয়ামত হাসান ভয়ে ভয়ে শক্ত হাতে গরুর লেজ ধরে থাকে। সাতরে গরু নদী পার হয়ে যায় সেইসাথে হাসানও।

চরে সাধারণত এক মৌসুম ক্ষেতি করা হয় তাই বড় বড় গাছপালা বা বাড়িঘর নাই। চারিদিকে একেবারেই খোলামেলা পরিবেশ। দিনের বেলাতে দৃষ্টিসীমার মধ্যে প্রায় পুরো চরটাই দেখা যায়। রাতের বেলা থাকে অন্ধকার আর আশেপাশের ঘরে জ্বলতে থাকা কেরোসিনের কুপি বাতির আলো। কিন্তু ব্যাতিক্রম হয় জ্যোৎস্না রাতে। দিনের মতই রাতেও পুরো চরটা দেখা যায় কিন্তু কোন একটা কিছু আলাদা মনেহয় হাসানের কাছে। সেটা যে কি তার শিশুমন ধরতে পারে না কিন্তু খটকাটা মনে থেকে যায়।

নদীর পারে, পটল, উচ্ছে, বাংগির ক্ষেত। স্কুল শেষ করে সেটা পাহারা দিতে আসে হাসান। আর ছুটির দিনে সারাদিনই থাকে। সারাদিন সব ছেলেরা দল বেধে নদীর পানিতে গোসল করতে যায়। যাওয়ার পথে নদীর উচু পারে গর্ত করে বাধা বাসা থেকে শালিকের ছানা ধরে নিয়ে আসে তারা। তাছাড়াও নদীর বালুচরে গজিয়ে উঠা কইউকরা, কাঠালিচাপা দিয়ে নানান রকমের খেলনা বানায় তারা। সবচেয়ে মজার খেলা হচ্চে কইউকরার সরু কালো শেকড় দিয়ে গোল চাকতির মত বানিয়ে সেটাকে ছেড়ে দিলেই সেটা বাতাসের চাপে ঘুরতে ঘুরতে অনেকদুর চলে যায়। তখন ছেলেরা সবাই মিলে সেটাকে কার আগে কে ধরতে পারে সেই প্রতিযোগীতায় মেতে উঠে।

নদী ভাঙন শুরু হোয়েছে। ঘরবাড়ি সরাতে হবে। পরীজান বিবি চিন্তা করলেন এরপর আবারো আমরা নদীর পাড়েই ঘর বাধবো এবং আবারো সেটা ভাংবেই। তাই মোটামুটি স্থায়ী একটা জায়গা কিনে একটা বাড়ি বানানোর দরকার। নদীর পাশে অবশ্য নতুন বাড়িটা করতেই হবে কারণ তানাহলে জায়গা জমি দেখাশুনা করবে কিভাবে। শহরতলিতে নতুন জায়গা কিনে বড় ছেলে আর তার পরিবারকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বড় ছেলে একদিন নৌকা ভাড়া করে সেখানে ঘরের খুটী-চালা বোঝায় করে নদীপথে রওয়ানা দেয় নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে। তার ছেলেরাও থাকে তার সাথে। ছেলেরা অবাক বিস্ময়ে ভাদ্রমাসের ভরা নদীর স্রোত, বিভিন্ন প্রকারের পাক দেখে আর জিজ্ঞেস করে কেন পানির মধ্যে এমন হচ্ছে।

চলছে বর্ষাকালের অঝোর ধারার বর্ষন। হাসিনা বেগম তার ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে আর বড় দুজনকে পাশে শুইয়ে ঘুমপাড়ানি ছড়া আউড়ে চলেছে। একসময় তিনি এবং তার ছোটছেলে ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু তার বড় এবং মেজো ছেলে শক্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে গভীর ঘুমে অচেতন হবার ভান করে। যেই না তিনি ঘুমিয়ে পড়েন তারা দুজন দৌড় দিয়ে বের হয়ে যায় বৃষ্টিতে ভিজতে। প্রথমে টিনের চানের কিনারে দাঁড়িয়ে একটু চুপচুপে হয়ে ভিজে তারা অভিযানে নেমে পড়ে। হুদাদের বাগানে বিভন্ন রকমের ফলের গাছ আছে বৃষ্টি হলে কিছু না কিছু পাওয়া যায়ই যায়। সেখানে থেকে কুড়ানি পর্ব শেষ করে তারা এসে ঝাপ দিয়ে নিহার বাবুর পুকুরে নামে। পুকুরের পানির মধ্যে ডুব দিয়ে তারা বাইরের বৃষ্টির ফোটার শব্দ শুনে। যেটা অনেকটা বলাই দাদার খোলের শব্দের মত।

হাসান বয়সে অনেক বড় হয়ে যাওয়ার পর একদিন হাতে পায় লাল শাপলা ফুলের প্রচ্ছদের একটা চটি কবিতার বই, নামঃ রূপসী বাংলা। হাসান কবিতা দুচোখে দেখতে পারে না, কারণ কবিতা মানেই অন্তত প্রথম আট লাইন দাড়ি কমাসহ মুখস্থ করতে হবে যেটা হাসানের জন্য অনেকটা পুলসেরাত পার হবার মত। কিন্তু এই কবিতার বইয়ের কবিতাগুলো কেন জানি তার খুব মনে ধরে গেলো। কেনজানি তার মনেহল এই কবি তার শৈশবের স্মৃতিময় দিনগুলোকেই বইয়ের পাতায় উঠিয়ে এনেছে। কবির নামঃ জীবোনানন্দ দাস। নামটা মনের মধ্যে এমনভাবে গেথে গেল যে সে হন্যে হয়ে এই কবির বই খোজা শুরু করলো। কিন্তু কেনার সামর্থ্য না থাকাতে ইচ্ছেটা ইচ্ছেতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেলো। আরো একটু বড় হয়ে চাকুরি করে এক সময় কিনে ফেললো জীবনানন্দ দাস সমগ্র। আব্দুল মান্নান সৈয়দের সম্পাদনায় তখন পর্যন্ত উনার প্রাকশিত অপ্রকাশিত সকল কবিতার সংকলন দুই মলাটের মধ্যে। বইয়ের প্রচ্ছদটা এখনও মনে আছে। সাদা জমিনের মধ্যে এলোমেলো শিউলি ফুল ছড়ানো। পড়তে শুরু করে দেয় সে, কিন্তু এগুতে পারে না। কারণ তার প্রায় প্রতিটা কবিতায় হাসানকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তার ফেলে আশা শৈশবের দিনগুলোতে।

এরপর থেকে হাসানের উপর ভর করে বসে জীবনানন্দ দাসের প্রেতাত্মা, কারণ উনি মারা গিয়েছিলেন অপঘাতে তাই উনার আত্মা হয়তো পৃথিবীতেই ছিল। এখন সেটা ভর করে আছে হাসানের উপর। এরপর থেকে হাসানের চরিত্রে কিছু মৌলিক পরিবর্তন হয়। জ্যোৎস্না রাতে সে কেন জানি ঘুমাতে পারে না। যদি ঘুমিয়েও যায় রাত্রের কোন না কোন একসময় সে হুড়মুড় করে জেগে উঠে। দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে চাদটা এখন কোথায়, সেটাকে কি দেখা যাচ্ছে না কি মেঘে ঢেকে গেছে। বৃষ্টির রাত্রে তারতো কিছুতেই ঘুম আসতে চাই না। ইচ্ছে করে সারারাত জেগে সে বৃষ্টি দেখবে (আসলে তার ইচ্ছে করে ভিজতে কিন্তু বাস্তবতার কারণে সেটা যেহেতু করা যাচ্ছে না তাই দেখেই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো আর কি)। রাত্রের বেলা পাশের গাছে শব্দ শুনে বের হয়ে এসে দেখে একটা বাদুর এসে সেই গাছে বসেছে। তখন হাসান তার মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় বসে পড়ে যতক্ষণ পর্যন্ত বাদুড়টা থাকে সেই গাছটাতে। রাত্রে অবিরাম শব্দে ডেকে চলা ঝিঝি পোকাটার একাকিত্ব তাকে উতলা করে। ছুটির দিনের দুপুরে বাসার বাইরের ঘাসের ডগার বাতাসের নাচন তাকে উদাস করে। ভোরে স্টেশনে যাওয়ার পথের ধারের বিভিন্ন ফুলের গন্ধ তার পথরোধ করে। এ যেন এক ভূতে ধরা রোগী যেখানে রোগীর সবকিছুই ভূতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর সেই অশরীরী আত্মার নামঃ জীবনানন্দ দাস। এখন মাঝ রাত পেরিয়ে গেছে, দুচোখে রাজ্যের ঘুম। সারাদিন ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে অনেক ছুটোছুটির পর অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই প্রেতাত্মা তাকে জাগিয়ে রেখেছে যে আজ থেকে তেপান্ন বছর আগে কোন এক দূর্ঘনায় অপঘাতে মৃত্যুবরণ করেছিল।

Md Yaqub Ali

Md Yaqub Ali

আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।


Place your ads here!

Related Articles

বাদল দিনে বাদল ধারা

ক্যানবেরার ছোট্ট বাঙালি কমিউনিটিতে বেশ কয়জন গুণী কবি- সাহিত্যিক, গীতিকবি, কণ্ঠ শিল্পী, তবলা বাদক আছে। ফেসবুক ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এদের

মাশরাফি’র বিদায় এবং আমাদের ভালবাসা

মাশরাফিকে একদিন বিদায় নিতে হতোই। কিন্তু দল আর দেশের জন্যে এত ত্যাগের ত্যাগী ম্যাশকে যেভাবে বিদায় দেয়া হচ্ছে, চাপের মুখে

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment