৩০ বছর ছুটি নেন না তিনি

by Priyo Australia | January 7, 2010 4:13 pm

শিক্ষকদের বলা হয়, মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষার্থীদের মানুষ করতে তাঁরা কত পরিশ্রমই না করেন। বিনিময়ে শিক্ষকেরা যা পান তা অতি নগন্য। কিন্তু এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে উজাড় করে দেন। বিনিময়ে কী পেলেন, কী পেলেন না তার হিসাব মিলিয়ে দেখেন না কখনো। এমনই এক ত্যাগী শিক্ষক টাঙ্গাইলের বাহাজ উদ্দিন ফকির (৫৩)। সাড়ে ৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এক দিনও প্রাপ্য ছুটি কাটাননি তিনি। বাবার মৃত্যু, স্ত্রীর অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—কোনো কিছুই তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি।

সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার ও নির্দিষ্ট ছুটির দিন বাদে রোজ স্কুলে গেছেন তিনি। মধুপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী এই শিক্ষককে দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তাঁর ছেলেমেয়েরাও হয়েছে বাবার মতো। স্কুল কামাই করে না তারা। শিক্ষকের দেখাদেখি শিক্ষার্থীদের অনেকে নিয়মিত স্কুলে আসে। সম্প্রতি স্কুলে গিয়ে কথা হয় মহান সেই শিক্ষকের সঙ্গে।

স্মৃতির পাতা থেকে: ১৯৯১ সালের জুলাইয়ের এক শুক্রবার। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে বাহাজ উদ্দিন গিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী জামালপুরের মাদারগঞ্জে, শ্বশুরবাড়িতে। পরদিন ভোরে রওনা হতে গিয়ে দেখেন হরতাল। রাস্তায় যানবাহন চলছে না। শ্বশুরবাড়ি থেকে একটা সাইকেল জোগাড় করে স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হলেন। ৪৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মধুপুরের কাছাকাছি এসে দেখলেন, সকাল সাড়ে ১০টা বেজে গেছে। এ গতিতে সাইকেল চালালে সময়মতো ক্লাসে পৌঁছানো যাবে না। তাই স্ত্রীকে পথে নামিয়ে একটা রিকশা ধরে বাড়ি চলে যেতে বললেন এবং নিজে দ্রুত সাইকেল চালাতে লাগলেন। স্কুল তখনো কয়েক কিলোমিটার দূরে। ১১টা বাজার কয়েক মিনিট আগেই ক্লাসে পৌঁছাতে পেরেছিলেন সেদিন।

বাবা আবদুল হামিদ ফকির মারা যান ২০০৩ সালের ২৭ জুন। দিনটা ছিল শুক্রবার। বাবার দাফন-কাফন সম্পন্ন করে পরদিন শনিবার সময়মতো স্কুলে হাজির হন বাহাজ উদ্দিন। পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। একটু জিড়িয়ে নিয়ে বলেন, ‘প্রথম সন্তানের জন্ম হয় নানাবাড়িতে। মেয়ে হওয়ার খবর শুনে মনে সে কী আনন্দ! ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই ছুটে যাই। কিন্তু স্কুল তো খোলা। তাই বন্ধের দিন গিয়ে দেখে আসি ফুটফুটে মেয়েটাকে।’
বিদ্যালয়ের কথা: মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ব্যবসায়ী নূরুর রহমান মধুপুর উপজেলা সদরে শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭২ সালে। অল্প দিনের মধ্যেই স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে। ১৯৭৯ সালের ১ জুন ওই স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন বাহাজ উদ্দিন। ১৯৯৫ সালে স্কুলটিতে উচ্চমাধ্যমিক শাখা চালুর পর নামকরণ করা হয় শহীদ স্মৃতি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। ২০০৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের সেরা ১০ কলেজের মধ্যে নবম স্থান অধিকার করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ২০০৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কলেজের পুরস্কার লাভ করে।

সিএল বোনাসের কথা: ২২ বছর আগে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূরুর রহমান শিক্ষকদের জন্য চালু করেন ‘ক্যাজুয়াল লিভ (সিএল) বোনাস’। যে শিক্ষক-কর্মচারী সারা বছরে এক দিনও স্কুলে অনুপস্থিত থাকবেন না, তাঁকে এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা দেওয়া হবে। ‘সিএল বোনাস’ চালুর পর বাহাজ উদ্দিন প্রতিবারই বোনাসটি পাচ্ছেন বলে জানালেন অধ্যক্ষ বজলুর রশীদ খান। তার আগের সাড়ে আট বছর বাহাজ উদ্দিন নিয়মিত স্কুলে এসেছেন। স্কুলের হাজিরা বই ও অন্যান্য কাগজপত্র ঘেঁটে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।

অনুসরণ করছেন অনেকেই: বাহাজ উদ্দিনকে এখন অনুসরণ করছেন তাঁর অনেক সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী এবং নিজের সন্তানেরা। তাঁর সহকর্মী সহকারী শিক্ষক আব্দুর রহিম গত সাত বছরে এক দিনও অনুপস্থিত থাকেননি। গত ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ১৪ জন শিক্ষক ও চারজন কর্মচারী বছরে এক দিনও অনুপস্থিত না থেকে ‘সিএল বোনাস’ পেয়েছেন।

বাহাজ উদ্দিন বর্তমানে দশম শ্রেণীর ‘গ’ শাখার শ্রেণীশিক্ষক। তিনি বলেন, ‘আমি আমার ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সব সময় বলি, আমি কোনো দিন ফাঁকি দিই না। তোমরাও নিয়মিত ক্লাস করবে, কোনো দিন ফাঁকি দেবে না।’ তিনি জানান, গত বছর তাঁর ক্লাসের ৮৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪১ জন এক দিনও অনুপস্থিত ছিল না।

বাহাজ উদ্দিনের সন্তানেরাও তাঁকে অনুসরণ করে। তাঁর বড় মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা শহীদ স্মৃতি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি এবং এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। সেও স্কুল-কলেজে নিয়মিত ক্লাস করত। দ্বিতীয় মেয়ে নিশাত রাবেয়া সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। সাত বছরের শিক্ষাজীবনে সে ষষ্ঠ শ্রেণীতে এক দিন মাত্র ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল। অসুস্থ নানার সেবা করতে গিয়ে সে ওই দিন ক্লাস করতে পারেনি।

জন্ম ও পড়াশোনা: বাহাজ উদ্দিন ফকিরের জন্ম ১৯৫৭ সালের ১ জুন, মধুপুর উপজেলার গোপদ গ্রামে। কৃষক বাবার টানাটানির সংসার। ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেই তিনি গৃহশিক্ষকের কাজ শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে রানী ভবানী পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ’৭৫-এ মধুপুর কলেজ থেকে এইচএসসি ও ’৭৭ সালে ধনবাড়ী ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।

শিক্ষকতায় নিবেদিতপ্রাণ এ মানুষটি জানান, বিদ্যালয়ে যোগদানের বছর তিনি দেখেন, পুরো এক বছরে এক দিনও বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত না থাকায় আব্দুর রশিদ ও শেখ আবদুল জলিল নামে দুই শিক্ষককে পুরস্কৃত করেছে কর্তৃপক্ষ। সেটা দেখেই অনুপ্রাণিত হন তিনি।

সবাই যা বললেন: শহীদ স্মৃতি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি নূরুর রহমান বলেন, ‘২২ বছর আগে মধুপুরের শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সেমিনারের আয়োজন করি। তখন একটি বিষয় বের হয়ে আসে, শিক্ষকেরা ছুটি কম নিলে লেখাপড়া বেশি হবে। তাই সিএল বোনাস চালু করি। বাহাজ উদ্দিনসহ অনেক শিক্ষক এই বোনাস পাচ্ছেন এখন।’

অধ্যক্ষ বজলুর রশিদ খান বলেন, ‘বাহাজ উদ্দিন ফকির অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে বিদ্যালয়ে টানা সময় দিচ্ছেন। ৩০ বছরের বেশি চাকরিজীবনে এক দিনও ছুটি নেননি তিনি। তাঁর এই ত্যাগ অনুসরণযোগ্য।’

সম্প্রতি মধুপুর সদরের আদালতপাড়ায় বাহাজ উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর স্ত্রী শামসুন্নাহারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সময়মতো তিনি স্কুলে গিয়ে হাজির হন। রান্না একটু দেরি হলে না খেয়েই চলে যান। কখনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার দরকার হলে বন্ধের দিন যান। খোলার দিন যত কাজই থাকুক, স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেন না। প্রথম প্রথম এটা বাড়াবাড়ি মনে হলেও এখন খুব ভালো লাগে। লোকে যখন তাঁর প্রশংসা করে তখন আমারও গর্ব হয়।’

বাহাজ উদ্দিন বলেন, ‘৩০ বছরে ৬০০ দিন আমার প্রাপ্য ছুটি নিইনি। এই ৬০০ দিন শিক্ষার্থীদের বেশি পড়াতে পেরেছি। আমরা যদি অযথা ছুটি না নিয়ে কাজ করি, তবে দেশ এগিয়ে যাবে।’

Link requested by Borhanuddin Shafi | original source[1]

Endnotes:
  1. original source: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-01-08/news/33363

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/readers-link/2010/%e0%a7%a9%e0%a7%a6-%e0%a6%ac%e0%a6%9b%e0%a6%b0-%e0%a6%9b%e0%a7%81%e0%a6%9f%e0%a6%bf-%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%bf/