মালিকানায় শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করে পোশাক শিল্পে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে প্রথম স্থান অধিকার করার আহ্বান

by Priyo Australia | October 31, 2013 10:57 pm

দেশের রাজনৈতিক এবং সুশাসনগত পরিস্থিতিতে সামগ্রীক পরিবর্তন না এনে বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে রানা প্লাজার মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে করণীয়র পাশাপাশি উন্নত দেশেরও এক্ষেত্রে অনেক দায়িত্ব এবং করণীয় আছে। যেখানে বাংলাদেশে উৎপাদিত তৈরী পোশাকের বিক্রয় মূল্যের ৬৩ শতাংশ ওয়াল-মার্টের মতো কোম্পানীরা আহরণ করে, সেখানে বাংলাদেশে শ্রমিক মজুরী বৃদ্ধিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে।

গত ২০শে অক্টোবর নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান এসব অভিমত ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) এবং প্রোগ্রেসিভ ফোরাম, নিউ ইয়র্ক যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে। বেনের বিশ্ব সমন্বয়কারী ডঃ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভার সূচনা করেন প্রোগ্রেসিভ ফোরাম, নিউ ইয়র্কের সভাপতি খোরশেদুল ইসলাম, এবং বেনের নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সী,এবং কানেক্টিকাট রাজ্য শাখার সমন্বয়কারী সৈয়দ ফজলুর রহমান সভা পরিচালনা করেন। সভায় বিপুল সমাগম ঘটে, এবং সভাকক্ষে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেককে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, কিংবা ফিরে যেতে হয়।

অধ্যাপক সোবহান বলেন যে, রানা প্লাজা ঘটনার মধ্যে বিভিন্ন দিকের প্রতিফলন দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছেঃ (ক) সুশাসনের ব্যর্থতা; (খ) রাজনৈতিক পরিবেশের ব্যর্থতা; (গ) সমাজের মধ্যে অন্যায় এবং অবিচারের উপস্থিতি; (ঘ) বিশ্বায়নসঞ্জাত প্রতিযোগিতার প্রবল চাপ; (ঙ) অন্যায্য বিশ্ব অর্থনীতি ব্যবস্থা। এসব প্রতিটি বিষয় ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক সোবহান বিস্তারিত তথ্যবহুল আলোচনা উত্থাপন করেন। গার্মেন্টস খাতের লাভক্ষতির বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান যে, বাংলাদেশে উৎপাদিত তৈরী পোশাকের ওয়ালমার্ট কর্তৃক বিক্রয় মূল্যে ভাগাভাগি নিম্নরূপঃ ওয়াল-মার্ট (৬৩%); ওয়াল মার্টের ভেন্ডর (৮.৩%); স্থানীয় (বাংলাদেশী) প্রস্তুতকারক (২৮.৭%)। স্থানীয় প্রস্তুতকারক প্রাপ্ত আয়ের বিতরণ নিম্নরূপঃ ঊৎপাদনের বস্তুগত উপকরণ (১৫.৫%); মজুরী (৫.১১%); কারখানা খরচ ও মুনাফা (৮.১%); স্থানীয় ক্রেতা (বায়িং হাউস) (২.৬%)। এ হিসেব থেকে দেখা যায় যে, মোট মজুরীর চেয়ে মোট মুনাফা বেশী; তদুপরি বিক্রয়মূল্যের সিংহভাগই বিদেশী কোম্পানীরা আত্মস্থ করছে। সুতরাং বিদেশী কোম্পানীদের মুনাফা এবং স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের মুনাফার কিয়দংশ দিয়ে শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি করা খুবই সম্ভব। এ ব্যাপারে একদিকে দেশীয় মালিকদের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; এবং সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, বিদেশী রাষ্ট্রদূত এবং দাতাসংস্থাদের প্রতিনিধিদের শুধু বাংলাদেশকে উপদেশ না দিয়ে তাদের নিজদের কোম্পানীদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা বাংলাদেশের স্থানীয় উৎপাদকদের পণ্যের বিক্রয়মূল্যের আরও বেশী অংশ প্রদান করে, এবং তার অংশ শ্রমিকদের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।

এ প্রসংগে অধ্যাপক সোবহান লক্ষ্য করেন যে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানীকৃত পণ্যের উপর ১৫% হারে আরোপিত শুল্ক থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রায় ৭৫ কোটি ডলার সংগ্রহ করে। বিপরীতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত বৈদেশিক ঋণ এবং সাহায্যের পরিমাণ মাত্র ২০ কোটি ডলার। সুতরাং বাংলাদেশী পণ্যের উপর শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে।

তিনি লক্ষ্য করেন যে, পোশাক শিল্পের মজুরী ১৯৯৬ থেকে প্রকৃতমূল্যে আরও হ্রাস পেয়েছে। শ্রমিকদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। অর্থনীতিতে তাদের মূল্যবান অবদান স্বীকৃত হচ্ছে না। ফলে তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। সেজন্য প্রতিদিনই এই শিল্পে শ্রমিক অস্থিরতার ঘটনা ঘটছে। কোন এক সময় তা সামাজিক বিস্ফোরণের রূপ গ্রহণ করতে পারে। তা এড়ানোর জন্য সময় থাকতে এখনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তিনি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেয়ার দাবী জানান। তিনি বলেন যে, শ্রমিকদের মজুরী ন্যায় সংগত পর্যায়ে উন্নীত করা দরকার। মুদ্রাস্ফীতির সাথে স্বয়ংক্রীয়ভাবে মজুরী বৃদ্ধি নিশ্চিত করা দরকার। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে শ্রম-ঘুর্নায়নের মাত্রা উঁচু। অর্থাৎ শ্রমিকেরা সামাণ্য মজুরী বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখলেই অন্যত্র কাজ নিচ্ছে। সে কারণে মালিকেরা আবার শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য দিকে বিনিয়োগ করছে না। শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি শ্রম-ঘুর্নায়ন হ্রাস করবে।

উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের একাত্মতা বৃদ্ধির জন্য তিনি শ্রমিকদের নিকট প্রতিষ্ঠানের মালিকানার একাংশ প্রদানের আহ্বান জানান। তিনি মনে করেন যে, তাহলে এই শিল্পে স্থিতিশীলতা আসবে, সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠত হবে, এবং বাংলাদেশ এই শিল্পে আরও এগিয়ে যেতে পারবে। তিনি লক্ষ্য করেন যে, চীনে মজুরী বৃদ্ধির কারণে পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। শিল্পের মালিকানায় শ্রমিকদের সংযুক্ত করার মাধ্যম বাংলাদেশ সেই সুযোগ বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

অধ্যাপক সোবহানের উপস্থাপনা বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি করে। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আদনান সৈয়দ, প্রকৌশলী ইমদাদুল ইসলাম, শামসাদ হুসাম, কবীর আনোয়ার, প্রমুখ। অধ্যাপক সোবহান সকলের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।

সভার দ্বিতীয় অংশে খুলনার রামপালে নির্মীয়মাণ বিতর্কিত তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র সম্পর্কে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ডঃ নজরুল ইসলাম এই আলোচনার সূত্রপাত করেন। তিনি সুন্দরবনের উপর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবের তালিকা দেন, এবং পাশাপাশি এসব অভিযোগের উত্তরে সরকারের বক্তব্য তুলে ধরেন। বিষয়টি নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন শামসাদ হুসাম, নিনি ওয়াহেদ, মুজাহিদ হোসেন, মুহম্মদ ফজলুর রহমান, জাকির হোসেন বাচ্চু, সুব্রত বিশ্বাস, কাশেম আলী, কবীর আনোয়ার, মুজিবুর রহমান, এবং অন্যান্যরা। সভায় অভিমত প্রকাশিত হয় যে, রামপাল সম্পর্কে আরও বিস্তারিত এবং তথ্যভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার, এবং বেনকে এরূপ আলোচনা আয়োজনের অনুরোধ জানানো হয়। উত্তরে ডঃ নজরুল ইসলাম আশা করেন যে আগামীতে এরূপ একটি আলোচনার আয়োজন করা হবে, এবং তাতে সকলে অংশগ্রহণ করবেন।

সভার সর্বশেষ অংশে আগামী ৩-৪ জানুয়ারী, ২০১৪ সনে ঢাকায় বেন ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র উদ্যোগে “পরিবেশ আন্দোলন এবং সংগঠন” সম্পর্কে বিশেষ সম্মেলনে বিষয়ে আলোচনা হয়। ডঃ নজরুল এই সম্মেলনের পটভূমি, উদ্দেশ্য, এবং মূল আলোচ্যসমূহ তুলে ধরেন। তিনি সকলকে এই সম্মেলনের বিষয়ে আগ্রহী হতে এবং অংশগ্রহণের আহবান জানান।

বেন এবং প্রোগ্রেসিভ ফোরামের পক্ষ থেকে সৈয়দ ফজলুর রহমান সকলকে অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ধন্যবাদ জানান।

************************************************************ Visit BEN’s website at “http://www.BEN-Global.org” and its current archive at “http://www.listserv.emory.edu/archives/ben.html”. For comments

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/community-news/2013/%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%85%e0%a6%a8-2/