by Shahadat Manik | April 13, 2019 7:12 pm
ভেবেছিলাম নুসরাতকে নিয়ে কিছু লিখবো না। লিখতে গেলে – আবার সেই অসহ্য ব্যাপার গুলি চোখের সামনে চলে আসবে। আমি নিতে পারবো না। কিন্তু বিধিবাম – কয়েক দিন থেকে, বেশ কিছু স্মৃতি বেশ খোঁচাখুচি করছে মাথায়। না লিখলে শান্তি পাবো না। লিখা উচিৎ। সেই সব কারণেই লিখছি।
আগে ভাবতাম জীবনটাই মাটি। মানুষের কথা শুনতে শুনতেই জীবনটা পার করে দিতে হবে, আমার কথা কেউ শুনবে না। আমার নিজের কথা কাউকে বলবো, এমন কোনো সুযোগ কখনো পাইনি। নেই ও। সবাই আমার কাছে আসে হালকা হতে। আর আমি? এখন ভাবি – ওটা সৃষ্টিকর্তার বেশ বড় একটা ভালোবাসা (ব্লেসিংস) ছিল আমার উপর। নিজের কথা বলার সুযোগ না পেয়েই লেখা শুরু করলাম এক সময়। যেখানে সেখানে, লিখে, লুকিয়ে রাখতাম। কাউকে দেখাতাম না। পরে অবশ্য সাপ্তাহিক শাহরাস্তি পত্রিকার সম্পাদক প্রয়াত আব্দুর রশিদ চাচা আমাকে বাধ্য করেছিলেন ওনার পত্রিকার জন্যে কবিতা লিখতে। হয়তো সে থেকেই কারো কারো সাথে নিজের লেখা দেখানো শুরু করেছিলাম।
নুসরাত জাহান রাফি। আমার মতোই লিখতো। যেখানে সেখানে লিখে রাখতো। আমার বিশ্বাস তার জীবন-যাপনটা ছিল একজন লেখকের মতো করেই। একজন লেখক যে ভাবে নিজেকে চিন্তা করে – নিজেকে চালিয়ে নেয়, সে ছিল তেমনই। আলোকিত, আত্মবিশ্বাসী – খোলা চোঁখের মানুষ। তাঁর সেই আলোকিত চোঁখই হয়তো এক সময় কাল হলো তার জন্যে। সেই জন্যেই হয়তো পশুটার অন্ধকারের ছায়া পড়লো তার উপর। নিভিয়ে দিলো তাঁর চোঁখের আলো। একজন লেখকের চোখের আলো।
মা, চোখ বন্ধ করিস না! মা, চোখ বন্ধ করিস না!! বাবা’র এই সামান্য কয়েকটি শব্দ – চোঁখের পাতা ভিজিয়ে দেয়, যে কারো কঠিন চোঁখের পাতাও, সহজেই। আমি তাঁর মৃত্যু সংবাদ, পত্রিকার লেখা গুলি, শিরোনাম দেখেই এড়িয়ে যাই – পড়ে দেখার সাহস হয় না। মানষিক শেষ শক্তি টুকুও হারিয়েছি হয়তো এখন। আর কত!
তখন আমার বয়স ৯ কি ১০ হবে। আব্বা ঠিক করলেন তিনি আমাকে মাদ্রাসায় দিবেন। তবে আরেকটু বড় হলে। তখন আমি, আমার আপা আয়েশা সহ আরো অনেক ছোট বড় সহপাঠী হুজুরের কাছে মক্তবে পড়তাম। তখনও আমার দুনিয়া সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা হয়নি (এখনো তেমন একটা নেই)! একদিন কথায় কথায় আপাকে বললাম আপা – হুজুর আমি যেখানেই বসি, ডেকে নিয়ে নিজের সাথে বসান। কারণ আমি অনেক দুষ্টামি করি, কথা বলি – পড়ায় মন দেই না। কিছু সুযোগ পেলে আদরের ছলে, কাছে টেনে নিয়ে পাছাটা টিপে দেন। হুজুর এমন কেন করেন আপা? আপা বললেন আর হুজুরের কাছে বসবি না।
আমার মাদ্রাসায় পড়া হয়নি – আরবী টা বেশ কঠিন মনে হচ্ছিল আমার কাছে।
দু’তিন বছরে অনেক হুজুর এলেন গেলেন। তারপর, একজন এসে খুব নাম করে ফেললেন। তাগড়া, নওজোয়ান – সুন্দর করে কথা বলেন। মুরুব্বিদের মধ্যে পেয়েছি “তাকে পেয়েছি” সাড়া পড়ে গেলো। পাড়া মহল্লা ছাড়িয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো হুজুরের সুখ্যাতি।
শিউলি আপা। আমার থেকে ৫/৬ বছরের বড়। আপার সাথে আমার খুব ভাব ছিল। আমরা দু জনেই বই বিনিময় করে পড়তাম। একদিন শিউলি আপা বললেন “জানিস মানিক, হুজুর সবাইকে ছুটি দিয়ে, আমাকে একা রেখে বিভিন্ন আজেবাজে কথা বলে” – আমি বললাম “আপা কি আজেবাজে কথা?” বলে “প্রথম বার করলে আল্লাহ মাফ করে দেয়” আমি বললাম “বলেন কি আপা? – তা কি করতে চায়?” আপা বললেন তুই বুঝবি না – হুজুর অনেক খারাপ। আমি বললাম “আপা – খুব খারাপ হলে, বাসায় বলে দেন” আপা বললেন – লাভ নেই; কেউ বিশ্বাস করবে না।
বাসায় এসে আয়শা আপাকে বললাম। তিনি বললেন ওনার সাথেও করেছে একই কাজ। আমার সমবয়সী একজন ছিল তাকে জিজ্ঞেস করতেই হেসে দিলো। বললো বাদ দে – এগুলি বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।
কেউ বিশ্বাস করবে না। কেউ না ?! আমার খুব খারাপ লেগেছিলো ব্যাপারটা জেনে। এখন বুঝি এ সমাজে “হুজুরদের” বিপক্ষে কিছু বলে, বিশ্বাস করানো কতটা কঠিন। কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। এক সময় আসে মেয়েদেরকেই বা কোনো কোনো সময়ে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা ছেলেদের হেরে যেতে হয় বিশ্বাসের কাছে আর আত্মসমর্পণ করতে হয় এই সমস্থ অন্ধকারে।
এখানে একটা কথা বলে রাখি যে, এই ব্যক্তি হুজুর না হলে – (এই মানসিক উচ্চতার ছেলে) এই ধরণের পরিবারে কখনোই প্রবেশ অধিকার পেতো না। ধর্মীয় কারণেই এরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজে, পরিবারে “এক্সামটেড” হয়। বিশ্বাসী হয়। তবে আমাদের সামাজিক অবক্ষয়, অলীক মূল্যবোধের কারণেই এরা পার পেয়ে পেয়ে একেক জন দৈত্যে পরিণত হয়, এক সময়।
আমাদের মত রক্ষণশীল পরিবারে বাংলা বা ইংরেজি ধারার গৃহশিক্ষক রাখার আগে রীতিমত শিক্ষকদের চৌদ্দ পুরুষের খোঁজ খবর নেয়া হয় এবং অভিবাবকরা “নিশ্চিত না হলে” কাউকেই কখনো শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় না। আর যদি ধর্মীয় শিক্ষক বা হুজুর হন তবে তা বিনা প্রশ্নে প্রথম থেকেই “এক্সামটেড” হয়ে যায়। পার পেয়ে যায় এই সব ইতর গুলি।
অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা ও “এক্সামটেড” ছিলেন ধর্মীয় সহ বিভিন্ন সামাজিক কারণে। যার ফলশ্রুতিতে হয়ত অনেক নির্জাতিতরাও “সম্মানিত অধ্যক্ষের নিঃশর্ত মুক্তি চাই” ব্যানার হাতে নিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিল সে দিন। এই বাচ্চা গুলি কে হয়তো বলা হয়েছে – শিক্ষকদের বা আলেমদের দোষ ত্রূটি গোপন করা ছওয়াবের কাজ – মুক্তির আন্দোলন না করলে গুনাহ হবে – দোজগে জ্বলতে হবে!
হয়ত, আজ এক সিরাজ কারাগারে – তবে একবার ভেবে দেখুন – লক্ষ লক্ষ্য সিরাজ যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে – তাদের ঠেকাবে কে? তাদেরকে নিয়ে আপনি, আপনাদের কি পরিকল্পনা?
এই সময়, সমাজ কি প্রস্তুত এই সব কীট পতঙ্গ সিরাজদের সমাজ থেকে বের করে দেয়ার জন্যে?
আপনার ছেলে মেয়ে – নাতি, নাতনী কি নিরাপদ – যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাকে পাঠাচ্ছেন? আপনি কি তাদের কথা শুনছেন? বিশ্বাস করছেন?
সাহাদাত মানিক
১২/০৪/২০১৯
Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2019/ma-chokh-bondho-korish-na/
Copyright ©2024 PriyoAustralia.com.au unless otherwise noted.