হবেই মানবতার জয়

by Md Yaqub Ali | August 8, 2019 4:19 pm

অস্ট্রেলিয়া মাল্টি কালচারের দেশ হলেও এখানে জাতিগত বৈষম্য কারো কারো মতে বেশ ভালো রকমের বিদ্যমান।  তাই এখানে বাসের ভিতরের দেয়ালে বর্ণ বৈষম্য বা জাতিগত বৈষম্যবিরোধি স্লোগান সমৃদ্ধ পোস্টার শোভা পায়। অনেকে অভিযোগ করে থাকেন কর্মক্ষেত্রে যখন কোন সাদা চামড়ার কাউকে যখন পাওয়া যায় না তখনই কেবল অন্য বর্ণের লোকদের সুযোগ দেয়া হয়। এমনকি পদোন্নতির ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করা হয় বলে অভিযোগ আছে। অবশ্য আমি আমার পাঁচ বছরের অস্ট্রেলিয়া জীবনের অভিজ্ঞতায় সবসময় এর উল্টোটাই দেখেছি। এখানে একজন মানুষকে সবকিছুর আগে মানুষ হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়।

কিছু মানুষ ব্যক্তিত্বগুণে জাত পাতের ব্যাবধান না করে সকল মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারেন। ওয়েন ঠিক সেই ব্যাতিক্রমধর্মি মানুষদের একজন। ওয়েন গ্রীনহাফ, বয়স ৫৯, জন্ম সিডনীতেই। শৈশব কেটেছে সিডনী শহরে। পরবর্তিতে সিডনীর দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর মিন্টোতে এসে থিতু হয়েছেন। ওয়েন বিগত ৩৪ বছর যাবৎ মিন্টোতে আছেন। প্রতিবেশি সবার কাছেই দারুন জনপ্রিয় ওয়েন। তার সদাহাস্যমুখ খুব সহজেই সবার আপনজন বানিয়ে দেয়। দুই কন্যা এবং তিনজন নাতি নাতনীর জনক। দ্বিতীয় সংসারে আছেন আরো দুই সন্তান যারা প্রতিবন্ধী।  তাই ওয়েনের বর্তমান গিন্নী কোন কাজ না করে বাড়িতেই অবস্থান করেন। 

সস্ত্রীক ওয়েন গ্রীনহাফ

সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে ওয়েন বিকেলে শুধু একবার তার পোষা কুকুরটাকে নিয়ে হাটতে বের হয় আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন দুটোতে সকাল-বিকাল দুবার হাটতে বের হয়। ২০১৬ সালের ১০ ই সেপ্টেম্বর শনিবার বিকেলে ওয়েন অন্যান্য দিনের মত তার পোষা কুকুরকে (অস্ট্রেলীয়াতে গৃহপালিত জীব জন্তুকে পরিবারের সদস্য হিসেবেই ভাবা হয় এবং পরিবারের অন্য সকল সদস্যের মত তাদেরও একটা করে নাম থাকে) সকালে বের হয়েছিল। ছেলেটাকে সে দূর থেকেই দেখলো। তার চাহনি দেখে মনেহল সে কিছু জিজ্ঞের করতে চাই। কিন্তু তাকে পার করে যাবার সময় কিছুই বললো না। ওয়েন তার হাটা শেষ করে যখন ফিরে আসছে তখনই ঘটলো ঘটনাটা। ছেলেটা হঠাতই তার শরীর বরাবর ছুরিটা চালিয়ে দিল। ওয়েনের বয়স হলেও শরীর এখনো বেশ মজবুত।  তাই ডান হাত দিয়ে ছুরিটাকে ঠেকাতে গেলে সেটা তার হাতে আঘাত করে ডান দিক দিয়ে বের হয়ে গেলো। মিস হয়ে গেলো দেখে ছেলেটা আবারো চেষ্টা করলো কিন্তু এবারও সে ওয়েনের শরীরকে মিস করে। কিন্তু ওয়েন এইবার বাম হাত দিয়ে ঠেকালো যার ফলে এইবার তার বাম হাতে আঘাত করে ছুরিটা বের হয়ে যায়।

ওয়েন দৌড় দিয়ে প্রতিবেশি মিসেস ডুয়েন ফেনের গ্যারেজের সেলুনে ঢুকে পড়ে। তারপর মিসেস ফেন এবং তার দুজন কাস্টমার মিলে কাঁচের স্লাইডিং দরজাটা বন্ধ করে দেয়। মিসেস মিরাবেল ব্রুকস দ্রুতই মিসেস ডুয়েনের একটা তোয়ালে পেচিয়ে ওয়েনের রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু ক্ষত বেশি হওয়াতে সেটা আর সম্ভব হচ্ছিল না। এই অবস্থায়ই ওয়েন বলে যাচ্ছিলঃ “আমি আমি ঠিক আছি, আমি একদম ঠিক আছি”। ইতোমধ্যেই ছেলেটা সেলুনের দরজায় এসে আঘাত করা শুরু করে দেয়। মনেহচ্ছিল যেন সে দরজা ভেঙ্গেই ফেলবে। প্রতিবেশি সেভেই ওহ চং দ্রুতই বুঝে ফেলে তারা যদি এই ছেলেটাকে তাড়াতে না পারে তাহলে সে হয়তো আজ ওয়েনকে আর বাচতে দিবে না। সেভেই তার ছেলেকে বলল কিছু একটা নিয়ে আসো যাতে আমি ছেলেটাকে প্রতিহত করতে পারি। ডেরেক তার বাবার কথা শুনে খুবই দ্রুত গ্যারেজে যেয়ে হাতের কাছে যে ঝাড়ুটা পেল সেটা নিয়ে আসলো। সেভেই নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে সেটা দিয়েই ছেলেটাকে পেছন থেকে আঘাত করে এবং বলে ছুরিটা ফেলে দাও। কিন্তু ছেলেটা কোনভাবেই ছুরিটা ফেলে দিতে রাজি ছিল না। পরবর্তিতে শস্ত্র পুলিশ এসে ছেলেটাকে প্রতিহত করে এবং গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।

হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর শনিবার রাতেই ওয়েনকে ছয় ঘন্টাব্যাপি সার্জারির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এরপর তাকে আরো বেশ কিছুদিন থাকতে হয় লিভারপুল হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। অবশেষে ওয়েন পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে কিন্তু তার একটা ডান হাতের একটা নার্ভ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়াতে সে আর তার ডান হাতের কেনে আঙুলে কোন প্রকার স্পর্শ অনুভব করে না। 

সদাহাস্য ওয়েন গ্রীনহাফ

একদিন রবিবার দুপুর বেলা ক্যাম্পবেলটাউন বাংলা স্কুলের কাজ শেষ করে স্কুলের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম। পাশ দিয়ে দেখি এক অসি ভদ্রলোক যাচ্ছেন। এক বড় ভাইকে বললাম যিনি একসময় ওয়েনের সহকর্মী ছিলেন তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তোমরা জানি ইনি কে? ইনি হচ্ছেন সেই ওয়েন যিনি কিছুদিন আগে একটা হঠাৎ আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। আমি অবাক বিস্ময়ে ভদ্রলোককে দেখছিলাম। উনার চেহারায় বা চখ-মুখের অভিব্যাক্তিতে তার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। শিশুর মত সরলতা নিয়ে আমাদের সাথে গল্প করলেন। যখন তারেক ভাই সেই ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিলেন উনি বললেন সবই ঠিক হয়ে গেছে শুধু এই আঙ্গুলটাতে কোন স্পর্শ অনুভব করি না।

এরপর উনি যে কথাগুলো বললেন সেগুলো এখনও আমার কানে বাজেঃ “ভাগ্যিস ঐদিন সেখানে আমার উপর আক্রমণ হয়েছিল। ভাব যদি কোন মহিলার উপর আক্রমণ হত অথবা যদি কোন বাচ্চার উপর আক্রমণটা হত তাহলে কত ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারতো।”

এরপর আমি বললাম তুমি যদি কিছু না মনেকর তোমার সাথে আমি একটা ছবি তুলবো। ধর্মের বা ইতিহাসের বা গল্পের নায়কদের চেয়ে বাস্তব জীবনের নায়করা আমার কাছে বেশি সম্মানিত কারণ আমার কত বড় সৌভাগ্য আমি এই মানুষগুলোকে সামনাসামনি দেখতে পাচ্ছি। আমার কথা শুনে সবাই রাজি হয়ে গেল একসাথে ছবি তোলার জন্য। আমার বন্ধু সেলফি এক্সপার্ট ঈশান আমাদের ছবি তোলার কাজটা সহজ করে দিল।

আমি সবসময়ই মানুষের উপর বিশ্বাস রাখি। একজন মানুষের বিপদের অন্য আর একজন মানুষ নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে এগিয়ে আসবে এটাই মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। তাই আমি সেই বড় ভাইকে ওয়েনের কিছু ব্যাক্তিগত তথ্য আমাকে যোগাড় করে দেন। ওয়েন তার প্রত্যুত্তরে একটা কাগজে তার ব্যাক্তিগত তথ্য সেই সাথে আরো কিছু কথা লিখে দিয়েছে সেটা আমি এখানে হুবহু তুলে দিলামঃ

ওয়নের হাতের লেখা

“The attack that happened to me was very scary.  I didn’t expect it to ever happen to me. But I’m just glad it wasn’t a women or child that it happened to.

The attack hasn’t changed my opinion on migrants. There are good and bad people in every race of people. I hold nothing against the Muslim people. All the local Muslim people have been fantastic and I thank them for that. Hopefully this never happens again. Thank you all from Wayne. Stay strong and look after your family please”

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে আসা একজন মানুষের মুখে মানব জাতি সম্মন্ধে এমন সুন্দর কথা শুনে আমি আরো দৃঢ়ভাবে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের উপর বিশ্বাস স্থাপন করি।

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2019/%e0%a6%b9%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%87-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%ac%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%9c%e0%a7%9f/