ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার পরাণসখা বন্ধু হে আমার

by Dilruba Shahana | May 22, 2019 7:17 pm

দিলরুবা শাহানা: খালি গলায় অর্থাত বাদ্যযন্ত্রছাড়া শাবানা আজমী গাইছিলেন  মনছোঁয়া গান ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার…’। এটা ছিল রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে  শাবানা আজমীর ট্রিবিউট টু টেগোর। অভিসার কথাটি মনে হলেই  মনে যে অনুভূতি  জাগে বা অনুভবে যে দৃশ্য  ধরা দেয় তা হল দু’জন ব্যাকুল হৃদয়  ছুটেছে এক অমোঘ আকর্ষণে। যেন দু’টি  তৃষিত হৃদয় একে অপরের সাক্ষাতের অপার আকাঙ্খা নিয়ে দূর্গম পারে যেতেও তৈরী। ভীষন ঝড়ঝঞ্ঝা, অবিরল বর্ষন, গাঢ় অন্ধকার অতিক্রমেও তারাও পিছ পা হবে না এমনি উতলা  হৃদয়মন।

তবে রবীঠাকুরের এই গানে ব্যাকুল হৃদয় একজন বলছে ‘দুয়ার খুলে বাহির পানে চাই, তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই’। তাইলে?  ব্যাপারটা কি? তবে কি একজনই পথে বেরিয়েছে অভিসারে? অন্য কেউ তার অভিসারের পথ কোনদিকে তা নিয়েই ভেবে মরছে? সে পথ সুদূর কোন নদীর কিনারে বা গহীন  কোন বনের ধারে কি? নাকি গভীর কোন অন্ধকার  পারি দিচ্ছে ‘পরাণসখা বন্ধু’।

অভিসারের রাতে আকাশ কেন কাঁদছে হুতাস সম? গানে গানে তাইই বলা হচ্ছে। আর দুয়ার খুলে কেইবা রহস্যময়ী একজন ‘হে প্রিয়তম’ বলে হাহাকার করছে? দু’টি হৃদয়ে যেমন তেমনি আকাশেও সে সময়ে আনন্দবৃষ্টি হওয়ার কথা নয় কি?

কোন একজন অভিসারে যে যাত্রা করেছে তার জন্য ঘুমহীন অন্য একজনের মানস চোখে ‘নদীর কিনার’, ‘গহীন বনের ধার’ ‘গভীর অন্ধকার’ দৃশ্যমান হয়ে চলেছে।

এখানে ‘পরাণসখা’ কোন অভিযানে যাচ্ছে না, যাচ্ছে সে অভিসারে। অভিসারে যেতে হৃদয়ভরা প্রেম প্রয়োজন। তবেই নিয়মকানুনের তোয়াক্কা  না করে নির্ভিক চিত্তে ছুটে যাবে অন্ধকার চিড়ে চিড়ে অনেক দূরে।

এমনি একজন ‘পরাণসখা’ যার হৃদয় উপচানো ভালবাসা কোন একটি নির্দিষ্ট পাত্রে ঢালার জন্য নয়। এ ভালবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য,  ভাসিয়ে নেওয়ার জন্য।

এমন ‘পরাণসখা’ আসেন কখনো, কখনো। যখন মানুষ অপমানিত হয়, লাঞ্ছিত হয় তুচ্ছ্ কারণে, অবদমিত হয় শক্তিমানের হাতে, নিরপরাধ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শ’য়ে শ’য়ে তখন  মানবতা কেঁদেঁ  মরে  সেই ‘পরাণসখা’র প্রত্যাশায়।

বাহুবলে অন্যের ধন সব কেড়ে নেওয়ার জন্য শক্তিমানের যুদ্ধ, সংঘর্ষ বহুকাল ধরে মানব সমাজে আছে। যুগ যুগ ধরে চলছে আগ্রাসন আর নির্যাতন যা মানবজাতির অজানা কোন বিষয় নয়। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের থাকে সৈন্যসামন্ত, গোলাবারুদ, কামান, এখন আরও আছে বোমারু বিমান ড্রোন যার খবরও মানুষ জানে। তবে সাজ সাজ রবে নয় চুপি চুপি যা ঘটে তাতো কারোর জ্ঞাত নয়।

এখন সময় ভীষন অন্ধকার। শুধুমাত্র সীমান্তে বা যুদ্ধের ময়দানে নয় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে সবখানে।  ধর্মশালায়ও মানুষকে বন্দুক দিয়ে গুলি করে পাখীর মত মারতে, বোমা দিয়ে শেষ করে দিতে  ইন্ধন জোগায় কে বা কারা? জানা আছে কি কারও?

তাই তো আজ মানবতা ‘আজি ঝড়ের রাতে অভিসার’এ আবাহন করছে এমনি  একজনের। যিনি এগিয়ে আসবেন মানুষকে রক্ষা করতে। ছিলেন সে সব ‘পরাণসখা’ যারা বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন জনপদে আত্মচিন্তা, স্বার্থচিন্তা একপাশে ঠেলে ফেলে  রেখে মানুষের জন্য হৃদয় উপচানো ভালবাসা নিয়ে অভিসারে বেরিয়েছেন।

তারা ধর্মপুরুষ নন। তারা মানুষ। মানুষের জন্যই তাদের প্রাণ কাঁদে।

অস্ত্র ছাড়াই তারা শক্তিশালী। শুধুমাত্র ভালবাসবার অসাধারন ক্ষমতার জন্যই  এরা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে আছেন আজও। থাকবেনও কাল থেকে কালান্তরে। পৃথিবী এদের কখনোই ভুলে যাবে না।

এমন তিনজনের দেখা  পাওয়া গেল এক প্রদর্শনীতে। নেদারল্যান্ডের আমর্স্টারডাম শহরে ২০১৭তে এক অসাধারন  অন্য রকম প্রদর্শনীতে এদের তিনজনের জীবন নানাভাবে দেখানো হচ্ছিল। প্রদর্শনীর নামটি খুব সুন্দর ‘এক্সিবিশন অব সিভিল লিবার্ট’। এরা হচ্ছেন সেই সব অনন্যসাধারন ‘পরানসখা’ যারা মানুষের সম্মান বাঁচাতে, মানুষকে অপমান ও গ্লানি থেকে মুক্ত করতে অগম পারে যাত্রা করতেও দ্বিধাহীন। মানবতা আকুল হয়ে থাকে সে সব ‘পরাণসখা’দের অভিসারের হদিশ জানতে।  মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় উপমহাদেশের একজন পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব উপনিবেশের শৃংখল থেকে মুক্ত হয়ে আপন সন্মান নিয়ে বাঁচতে ও সবাইকে বাঁচাতে ছিল যার নিরস্ত্র অভিযান বা অভিসার।  মার্টিন লুথার কিং  উত্তর আমেরিকা তথা মার্কিন দেশের নাগরিক অধিকার আন্দোলনে নিবেদিত একজন ‘পরাণসখা’ আর একজন নেলসন ম্যান্ডেলা আফ্রিকার মর্যাদার প্রতীক ও পৃথিবী জুড়ে সর্বজন মান্য একজন মানুষ।

আরেক জন মানুষ বুকে অপার ভালবাসা পোষে দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে বেড়িয়েছেন মানুষের মুক্তির আকাংখায় । তার প্রতিকৃতি আজও দেখা যায় তরুণের জামার বুকে, মাথার ব্যান্ডেনায় ও টুপিতে। আর তাকে দেখা গেল পৃথিবীর নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের  সিড়ি দিয়ে উঠার পথে টাংগানো এক দেয়ালচিত্রে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি  হচ্ছে বিখ্যাত লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স। এমন এক জায়গায় ঝুলছে যে ছবি তাতে আছেন সেই স্বাপ্নিক তরুণ যার বুকে ছিল ভালবাসা আর হাতে ছিল অস্ত্র।  মন্ত্রীত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ  পদ অবহেলায় ছেড়ে যিনি পথে বেরিয়েছিলেন মানুষকে  দুঃখকষ্ট থেকে  মুক্তি এনে দিতে। শুধু সাধারন মানুষের জামার বুকে নন তার কাংখিত স্বপ্নের আলোয় ছুঁয়ে দিয়ে যান  শিক্ষিত বোদ্ধাদেরও। ইনিও  একজন ‘পরাণসখা’ মানবতার আকাশ তার জন্যও কাঁদে হুতাস হয়ে।

তাকে এলএসইর দেয়ালে টাঙ্গানো চিত্রকর্মে দেখা হতো না যদি না শিক্ষক সুপারভাইজারের পরামর্শ শুনে আমার এককালীন বিদ্যাপিঠের নতুন বিল্ডিং দেখতে না যেতাম। সুপারভাইজার তখন  ভ্যাকেশনে ফ্রান্সে। আমি অনেক বছর পর একা নই স্বামীসহ লন্ডনে গিয়েও তার দেখা পাবনা ভেবে মন খারাপ হল। জানালেন

-স্কুলে যেও, নতুন সব নির্মান দেখবে, ঝকঝকে ক্যাফে হয়েছে দেখে এসো।

খুব যে উৎসাহ পেলাম তার কথায় তা নয়। তবুও পাতাল রেলে চড়ে  বসলাম। একসময়ে হলবর্ন   স্টেশনে  নামলাম। গভীর মাটির তল থেকে দু দু’বার দীর্ঘ সিড়ি ভেঙ্গে  উপরে উঠলাম। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বা দিকের রাস্তা ধরে এগুতেই সেই পরিচিত বুশ হাউজ (BVSH HOUSE) চোখে পড়লো। এখানে ইংরেজী অক্ষর ‘ইউ’ লিখিত ‘ভি’এর মত। এলএসই পৌঁছে চোখে পড়লো  ঐতিহ্যবাহী  পুরান সব দালানকোঠার পাশেই নতুন বিল্ডিং মাথা তুলেছে । আমি পুরানো বিল্ডিংএ গেলাম পুরানো দিনকে মনে করতে।

সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে এ শিল্পকর্ম চোখে পড়লো। পুরনো জায়গায় আমার ঐতিহ্যবাহী  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে নতুন কিছু খুঁজে পেলাম। আগে তো এই বিল্ডিংটা ছিলই এমন চিত্রকর্ম ছিল কি?  হয়তো ছিল, হয়তো ছিল না। তখন পড়াশুনার চাপে চারপাশের সবকিছু  মনোযোগসহ দেখা হয়ে উঠে নি আর। আমার স্বামী উৎসাহ নিয়ে এই চিত্রকর্মের ছবিটি ক্যামেরা বন্দী করলেন। তারপর যাকেই  ছবিটি দেখিয়েছি চে গুয়েভারাকে  চিনতে কেউ মুহূর্ত  দেরী  করেনি। মূলকথা  মানবতাতো রবীঠাকুরের গানের সুরেই হাহাকার করে ‘পরাণসখা’র জন্য। তাই  মানুষের স্মৃতি থেকেও বিস্মৃত হয়ে যাবেন না এরা কখনোই, কোনদিন।                                              

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2019/%e0%a6%9d%e0%a6%a1%e0%a6%bc%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%a4%e0%a7%8b%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%85%e0%a6%ad%e0%a6%bf%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%aa/