শরতের সকাল

by Md Yaqub Ali | April 8, 2018 11:00 pm

শরৎ কাল আসার পর থেকেই দাদির মুখে একটা শ্লোক শুনতামঃ আইলোরে আশ্বিন, গা করে শিনশিন; পৌষের জারে (শীতে) মহিষের শিং লরে (কাঁপে); মাঘের শীতে বাঘ কাদে। পুরো ছড়াটা ঠিকঠাক মনে নেই আর দাদিরও অনেক বয়স হয়ে গেছে তাই দাদিও আর মনে করতে পারেন না। কিন্তু ছোটবেলায় উনার মুখে শুনে শুনে আমরা ছোটরাও কোরাসে বলতাম ছড়াটা। শরৎ কালের দ্বিতীয় মাস আশ্বিন থেকেই খুবই হালকাভাবে শীত পড়া শুরু করতো বলেই হয়তো ছড়াটা শুরু হয়েছিল আশ্বিন মাসকে দিয়ে। তবে আমার যেটুকু মনে আছে সেটা হচ্ছে ভোরের দিকে সামান্য শীত পড়তো কিন্তু দিনের আলো বাড়ার সাথেসাথে আর শীতটা থাকতো না উল্টা গরম লাগা শুরু হত। শরৎ কালের শীতের মধ্যে একটা কোমল ভাব ছিল। যেটার তীব্রতা ধীরেধীরে বেড়ে মাঘ মাসে এসে তীব্রতা একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছোত।

অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতিতে শরতের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে কুয়াশা। [1]

অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতিতে শরতের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে কুয়াশা।

শরতের শীতের ভোরগুলো ছিল আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। এমনিতেই মা অনেক ভোরে উঠে রান্নার কাজ শুরু করে দিতেন কিন্তু শরতের ভোরে মা নিয়মিত রান্নার শুরু করার আগে প্রায়ই সামান্য পিঠা বানাতেন বিশেষকরে ছোটদের জন্য। আমি রান্নাঘরের টুংটাং শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে রান্নাঘরে গেলে মা গায়ে হালকা শীতের কাপড় পরিয়ে আমাকে মাটির চুলার পাশে বসিয়ে দিতেন। মাটির চুলায় খড়কুটো দিয়ে রান্না। এই আগুন তো এই ধোয়া এভাবেই রান্নার কাজ এগিয়ে চলতো। আমি চুলার পাশে বসে চোখ মুছতাম আর মায়ের পিঠা বানানো দেখতাম। এই পিঠাগুলোর মধ্যে ভাপা পিঠাটা ছিল সবচেয়ে সাধারণ। চালের গুড়ার মধ্যে পরিমাণমত পানি মিশিয়ে সেটাকে বাটিতে নিয়ে চুলায় সিদ্ধ হতে থাকা মাটির সরার উপর বসিয়ে দিয়ে ঢেকে দিলেই পিঠা তৈরি হয়ে গেল। সিদ্ধ পানির ভাপ মাটির সরার কেন্দ্রের ছিদ্র পথে এসে চালের গুড়াগুলোকে সিদ্ধ করে দিত। তারপর সেই পিঠা কোলায় (গুড় রাখার পাত্র) রাখা গুড় দিয়ে খাওয়া হত। অনেক পরে শহরে এসে জেনেছি এর মধ্যে গুড় আর নারিকেল দিলে সেটার স্বাদ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু আমার কেন জানি একেবারে সাদা সেই ভাপা পিঠাটাই ভালো লাগতো।

শহরতলীতে আসার পর শরৎ কালের আবাহাওয়ায় পরিবর্তন তেমন একটা না আসলেও আমাদের জীবনমানে আমূল পরিবর্তন এসেছে ততদিনে। নদী ভাঙনে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে শহরের প্রতিকূল পরিবেশে আব্বা প্রতিদিনই বিভিন্ন কাজের চেষ্টায় সকাল সকাল বের হয়ে পড়তেন। আর ঠিক তখনই পাশের গ্রাম চৌড়হাস থেকে একজন মহিলা কাকালে করে ঝুড়িতে করে ভাপা পিঠা ফেরি করতে আসতেন আমাদের গ্রামে। উনাকে আমরা ফুপু ডাকতাম। ফুপু কাকালে কলসি ধরার মত করে একটা ঝুড়ি ধরে রাখতেন। তার উপরটা কাথা দিয়ে ঢাকা থাকতো। সেই কাথার নিচে কলাপাতায় মোড়ানো বিভিন্ন আকারের ভাপা পিঠা থাকতো। আমার যতটুকু মনেপড়ে সবচেয়ে ছোটটা আট আনা, মাঝারিটা এক টাকা আর সবচেয়ে বড়টা দুই টাকায় বিক্রি করতেন। উনি এসেই হাক ছাড়তেন, এই পিঠা ভাপা পিঠা। আর আমরা মায়ের কাছে আবদার করতাম সেটা কিনে দেয়ার জন্য। সবসময় যে মা আবদার রক্ষা করতে পারতেন এমন না তবে বেশিরভাগ সময়ই কিনে দিতেন।

শরতের ভোরে শিশিরে পা ভিজিয়ে হাটা। [2]

শরতের ভোরে শিশিরে পা ভিজিয়ে হাটা।

শরৎ কাল আসলেই আবহাওয়াতে যে পরিবর্তনটা দৃশ্যমান হত সেটা হচ্ছে ভোরের দিকে কুয়াশা পড়া শুরু হয়ে যেত। আমরা ছোটরা ফজরের নামায পড়ে এসে পারাময় হেটে বেড়াতাম একসময়। কেউ একজন একদিন বলেছিল শিশিরে পা ভিজিয়ে হাটলে বুদ্ধি বাড়ে। ব্যস, এরপর থেকে আমরা ঘাসের মধ্যে খালি পায়ে হেটে বেড়াতে শুরু করলাম। ঘাসের ডগা থেকে মুক্তোর দানাগুলো আমাদের পায়ে এসে পড়তো আর কেমন একটা শিহরণ অনুভব করতাম। একসময় আমরা জেনে গেলাম বুদ্ধি বাড়ার সাথে শিশিরের কোন সম্পর্ক নেই কিন্তু তবুও শিশিরে পা ভিজিয়ে হাটতে আমাদের খুবই ভালো লাগতো বলে আমরা আর অভ্যাসটা ত্যাগ করলাম না। অনেক বড় হয়ে গ্রামে গেলেও বন্ধুরা সবাই মিলে শিশিরে পা ভিজিয়ে হাটতাম। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি আমি যদি এখনও গ্রামে ফিরে যায় শরতের ভোরে ঘুম থেকে উঠে একই কাজ করবো।

অস্ত্রেলিয়ার ঋতুবৈচিত্রে পরিবর্তনটা ঘটে বাংলাদেশের একেবারে উল্টো সময়ে। যদিও বলা হয় এখানে মাত্র চারটা ঋতুঃ গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত এবং বসন্ত। কিন্তু আমার মনেহয় এখানে আসলে দুইটা ঋতুঃ শীত এবং গ্রীষ্ম। বাকিগুলোর পরিবর্তন খুব একটা চোখে পড়ে না তবে আপনি যদি প্রকৃতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন তাহলে পরিবর্তনগুলো টের পাবেন। এবং এখানেও বাংলাদেশের মতই ছয়টা ঋতু আছে। তবে আজ আমরা শুধু শরৎ নিয়েই কথা বলবো। গরমের পর সামান্য শীত পড়তে শুরু করেছে কিন্তু বুঝে উঠতে পারি নাই যে ঋতু পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ চলতি পথে কাশফুলের দোল আপনাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে জানিয়ে দিয়ে যাবে শরৎ দোরগোড়ায়। তবে এখানে যেহেতু বাংলাদেশের মত অহরহ কাশফুল পাওয়া যায় না তাই পরিবর্তনটাও মানুষের চোখ এড়িয়েই যায়।

সুদূর অস্ট্রেলিয়াতে তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের ভাপা পিঠা। [3]

সুদূর অস্ট্রেলিয়াতে তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের ভাপা পিঠা।

কিন্তু আমি আর আমার মেয়ে তাহিয়া যেহেতু একটু পাগল টাইপের তাই প্রকৃতির এই পরিবর্তনগুলো ধরে ফেলি। একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি চারিদিকে কুয়াশা পড়ছে। আমরা তখন সাইকেল নিয়ে বের হচ্ছি পাড়াময় একটি চক্কর দেয়ার জন্য। আমরা সাথেসাথে বুঝে গেলাম শরতের আগমন ঘটেছে। আমরা সাইকেল চালানো শেষ করে এসে শিশিরে পা ভিজিয়ে অনেকক্ষণ ধরে হাটাহাটি করলাম। এরপর একসময় আমরা কাশফুলও জোগাড় করে ফেললাম। সেই গল্প ইতোমধ্যেই বলা হয়ে গেছে। তখন আমরা ভাবলাম কিভাবে ভাপা পিঠার ব্যবস্থা করা যায়। বাংলা দোকানে যেয়ে খুঁজে পেয়ে গেলাম বাংলাদেশের ভাত রান্না করার পাতিলের মত পাতিল। তবে ডিজিটাল যুগ বলেই হয়তোবা পাতিলের সাথে একেবারে আটকানো রয়েছে সাত ছিদ্র বিশিষ্ট একটা সরার মত বস্তু। আমরা তক্ষুণি সেটা আর সাথে চালের গুড়া নিয়ে বাসায় এসে বানাতে শুরু করে দিলাম।

এই পাতিলের মধ্যে পানি দিয়ে সেটা ফুটে উঠার পর বাংলাদেশের নিয়মেই আমরা পিঠা বানাতে শুরু করলাম পরীক্ষামূলকভাবে। মাত্র তিনটা বানিয়েই আমরা সাফল্য পেয়ে গেলাম তাই সেদিনের মত আর বানানো হল না। কিন্তু মুশকিল বাধলো পিঠা বানানোর শেষে পাত্র পরিষ্কার করতে যেয়ে। যেহেতু পাত্রের মুখের সাথে সরার মত বস্তুটা একেবারে লাগানো এবং সেটা পাত্রের ভিতরের দিকে বাকানো তাই পাত্রটা থেকে সম্পূর্ণরুপে পানি পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন আমি স্ট্যাপ্লার রিমুভার নিয়ে পাত্রের মুখ থেকে ঢাকনা খুলে ফেলতে লেগে গেলাম। অনেক সময় ব্যয় করার পর ঢাকনাটা একটু আলগা হল কিন্তু সেটা খোলা গেল না। সকালবেলা প্রতিবেশী নাজমুল ভাইয়ের কাছ থেকে প্লায়ার্স নিয়ে এসে সেটা সরিয়ে ফেলতে পারলাম। এরপর আমরা আর তাহিয়ার বান্ধবীই জেইনারা মিলে পরিকল্পনা করলাম আবারো একবার পিঠা বানানোর। আমাদের এই ছেলেমানুষিতে বরাবরেই মত উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে এলেন নাজমুল ভাই এবং সন্ধ্যা ভাবি। এরপর আমরা বানিয়ে ফেললাম একেবারে বাংলাদেশের ভাপা পিঠা। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় এই প্রবাদটার প্রমাণ আবারো হাতেনাতে পেলাম।

শরৎ কালের অনুষঙ্গ কাশফুল আর ভাপা পিঠা। [4]

শরৎ কালের অনুষঙ্গ কাশফুল আর ভাপা পিঠা।

বিদেশের যান্ত্রিক জীবনের আনন্দগুলোকেও কেন জানি আমার কাছে যান্ত্রিক আর একঘেয়েমি লাগে। তাই বৈচিত্র আনার জন্য আমরা বিভিন্ন ধরণের পাগলামি করি যেটাএ রসদ জোগায় আমার শৈশবের গ্রাম বাংলার আবহমান কালের স্মৃতি। আর সাথে সাথে নতুন প্রজন্মের মনেও স্মৃতি তৈরি হয়ে যায়। তৈরি হতে থাক নতুন নতুন স্মৃতি। যাতেকরে ওরা যখন বড় হয়ে অতি যান্ত্রিকতায় হাপিয়ে উঠবে তখন যেন শৈশবের স্মৃতিময় দিনগুলোতে উঁকি দিয়ে একটু জিরিয়ে নিতে পারবে।

Endnotes:
  1. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/04/1-3.jpg
  2. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/04/2-3.jpg
  3. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/04/3-3.jpg
  4. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/04/4-2.jpg

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2018/%e0%a6%b6%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b2/