প্রবাসে স্বজন

by Md Yaqub Ali | July 30, 2018 4:50 pm

আব্বা-মাকে ফেলে জীবনে প্রথম বাইরে থাকা বুয়েটে চান্স পাবার পর। আমি জীবনে আব্বা-মাকে কখনই কোন সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলি নাই কারণ আমাদের সম্পর্কগুলা ছিল খুবই স্বাভাবিক। আব্বা ছিলেন সবচেয়ে ভালো বন্ধু, খেলার সাথী আর মা ছিলেন চলার পথের পথ প্রদর্শক। তাই বাড়িতে থাকতে তাদের জন্য আলাদা করে তেমন কোন কিছু অনুভব করতাম না। কিন্তু হলে থাকার শুরুর দিনগুলো ছিল আমার জন্য খুবই কঠিন। প্রায় প্রতি দু-সপ্তাহান্তেই বাড়ি চলে যেতাম। মনে আছে ছোট বেলায় একবার নানি আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল আমি বাইনা ধরলাম নানির সাথে যাবো। আমাকে অনেক বুঝানো হল কিন্তু আমি কোনভাবেই কারো কথা না শুনে নানির সাথে হাটা দিলাম। এখনো মনে আছে দিনশেষে আমি নানিবাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে যতদূর আসা সম্ভব আমাদের বাড়ির দিকে চলে আসিতেছিলাম। আমাকে কেউই আটকাতে পারছিল না। যেই আসছিল সেই আমার হাতের উত্তম মধ্যম খাচ্ছিল । ইতোমধ্যেই নানির সারা মুখে শুধু আমার খামচির দাগ বসে গেছে। ফর্সা মুখটা একেবারে লাল হয়ে গিয়েছিল। এরপর কিভাবে রাত পার করেছিলাম সেটা আজ আর মনে নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব আমি আর পাভেল (সানজাদ) প্রায় প্রতি দু সপ্তাহে কুষ্টিয়া যাওয়ার অভ্যাসটা ধরে রেখেছিলাম।

পড়াশুনাটা কখনই আমার কাছে বোঝা মনেহত না কারণ স্কুলের বাইরে পড়াশুনায় চাপ দেয়ার মত শিক্ষিত মানুষ আমাদের পরিবারে ছিল না। যিনি ছিলেন তিনি আমার মেজো আব্বা (মেজো চাচা) কিন্তু উনি থাকতেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে। তাই পড়াশুনাটা আমার কাছে ছিল আর আট-দশটা খেলার মতই। যখন ইচ্ছা পড়লাম যখন ইচ্ছা হল না পড়লাম না। পড়তে বসেছি পাড়ার ছেলেরা হয়তো জানালার পাশে এসে বলল, গাদনের (এক ধরণের খেলা) কোর্ট কাটতে হবে। ব্যস, হইহই করে চললাম গাদনের কোর্ট কাটতে। টানা ঘনটার পর ঘন্টা পড়া আমাদের রুটিনে কখনই ছিল না। আব্বা জীবিকার তাগিদে সারাদিন বাইরে থাকতেন। আর মা সংসারের সকল কাজ সেই সাথে ছোটকে দেখাশুনা, সবমিলিয়ে আমাদের দিকে নজর দিতে পারতেন না তেমন একটা। দিনে হয়তো একবার বা দুবার বলতেন, পড়তে বস। কিন্তু আমাদের দুভাইয়ের পরীক্ষার ফল কখনই কিন্তু তেমন খারাপ ছিল না।

ঢাকায় আসার পর অবারিত স্বাধীনতা পেয়ে গেলাম। হঠাত করে একসাথে অনেক কাজ করতে শিখতে হল। যেই আমি গোসল করে কলপাড়ে কখনই পরনের লুঙ্গিটা পর্যন্ত ধুইতাম না সেই আমি নিজে নিজেই সব কাপড় ধোয়া শিখে গেলাম। প্রথম কাপড় কাঁচতে যেয়ে কোথায় জানি খোচা লেগে হাতের আঙ্গুলে সামান্য কেটে গেল। সেটা চিঠিতে মাকে জানিয়েছিলাম। পরের সপ্তাহে বাসায় যেয়ে শুনি আমার মা সেই চিঠি পড়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত না কি ঠিকমত খান নাই। এমনিতেই পড়াশুনাটা আমার কাছে তেমন কোন প্রিয় বস্তু ছিল না উপরন্তু বুয়েটের শিক্ষকদের অতি খবরদারি আমাকে পড়াশুনার প্রতি একেবারেই বীতশ্রদ্ধ করে তুলল। বুয়েটে এসে জীবনে প্রথমবারের মত ডিগবাজি দেয়ার স্বাদও নিতে হয়েছিল। সারাক্ষণই কান খুবই সচেতনভাবে দু-শব্দের একটা বাক্য শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতোঃ পড়তে বস।

ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরতাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি আব্বা-মাকে জানতাম না বা জানানোর সামর্থ্য ছিল না। আর রওয়ানা দিতাম ক্লাস শেষ করে বিকেল বা সন্ধ্যার বাসে। তাই বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে কখনও মাঝরাত কখনও ভোর রাত হয়ে যেত। আমি যখন বাড়ি পৌছে মাকে ডাকতাম। মাকে শুধু একবারই ডাক দিতে হত, উনি উঠে দরজা খুলে দিতেন। আমার কাছে মনে হত উনি দরজার কাছেই বসেছিলেন আমার ডাক শুনে দরজা খুলে দিলেন। আমাকে কখনোই জীবনে মাকে দ্বিতীয়বার ডাক দিতে হয় নাই। আব্বা-বলতেন আমার ঢাকা চলে আসার শুরুর দিকে মা না কি রাতের বেশিরভাগ সময়ই ঘুমাতেন না। বারবার দরজা খুলে বাইরে দেখতেন এই বুঝি তার ছেলে ফায়ার এল। যখন বাড়ি থেকে চলে আসতাম মা কখনোই কান্নাকাটি করতেন না। মনের মধ্যে যতই কষ্ট হোক বাইরে প্রকাশ করতেন না। আমার চলে আসার পথের দিকে চেয়ে থাকতেন যতক্ষণ আমাকে দেখা যায়। আমি বারবার বলতাম তুমি বাড়ি ফিরে যাও. উনি বাড়ি ফায়ার যেতেন না। পরে পাড়ার লোকের মুখে শুনেছি আমাকে যখন আর দেখা যেত না মা সেইখানেই বসে কান্নাকাটি শুরু করতেন। তাকে আর সেখান থেকে উঠানো যেত না।

[1]

সৃষ্টিকর্তা সবসময়ই আমার চারপাশে কিছু অতিমাত্রায় চমৎকার মানুষ পাঠিয়ে দেন সবসময়। যারা আমার জীবনযাত্রাকে খুবই সহজ করে দেন। আমি আমার জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে তার প্রমাণ পেয়েছি, এখন পর্যন্ত পেয়ে যাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও পাবো এই ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। আমাকে খুব ভোরে উঠে তৈরি হয়ে অফিসের জন্য রওয়ানা দিতে হয়। বাসা থেকে ষ্টেশন পর্যন্ত হেটে আসা-যাওয়া করি। এই আসা-যাওয়াতে প্রতিদিনই কোন না কোন নতুন গল্প তৈরি হয়। অনেক নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয়। রাস্তার পাশের ফুল-ফলের গাছ থেকে নিয়মিত চুরির অভ্যাসটাতে আবার একটু শান দিয়ে নেই। ইদানিং সকাল বিকাল, সময়ে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে সেটাও উপভোগ করছি। এমনই এক মুষলধারে বৃষ্টির দিনে এক বাসা থেকে ইয়াবড় আকারের একটা লেবু ঝেড়ে দিয়েছিলাম।

একদিন আমি বাসা থেকে বের হয়েছি, তার কিছুক্ষণ পরে প্রথমে ইলশে গুড়ি এবং একটু পরেই মূষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। কিন্তু ততক্ষণে আমি প্রায় স্টেশনে পৌছে গেছি। হঠাত পকেটের মধ্যে ফোনটা কেপে উঠলো। কলটা রিসিভ করতেই

ভাবি বললেন, তুমি কি বাসা থেকে বের হয়ে গেছো?

আমি বললাম: জি, আমিতো স্টেশনে পৌঁছেও গেছি ভাবি।

: আচ্ছা ঠিক আছে তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলো।

ভাইয়া: শোন এখন থেকে আবহাওয়া খারাপ থাকলে বা কোন ইমার্জেন্সি হলে তুমি অবশ্যই জানাবে। আমি তোমাকে স্টেশনে ড্রপ করে আসবো।

আমি: জি ভাইয়া, আমি অবশ্যই জানাবো।

অন্য আরেকদিনের কথা। সেদিনও সারাদিন থেমে থেমে কখনও একটানা, কখনও আস্তে আস্তে আবার কখনও মূষলধারে বারিধারা ঝরে চলেছে। আমি অফিস থেকে বের হয়ে বাসে করে গ্রীন স্কয়ার স্টেশনে পৌছে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি ভাইয়ার মিসড কল। কল ব্যাক করার পর

ভাইয়া জানতে চাইলেন: তুমি এখন কোথায়?

আমি: জি ভাইয়া, আমি স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি।

: আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি গ্লেনফিল্ড এসে আমাকে জানিও তোমাকে স্টেশন থেকে পিক করবো।

ফেসবুক ব্যবহার করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলাম কখন গ্লেনফিল্ডের কাছাকাছি চলে এসেছি।

হঠাৎ আবার ভাইয়ার ফোন: এখন কোথায় তুমি?

: জি ভাইয়া, গ্লেনফিল্ডের কাছাকাছি।

: আচ্ছা ঠিক আছে, আমি স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছি।

[2]

একসময় আব্বা-মাকে ফেলে এক মুহূর্ত থাকতে পারতাম না। সেই আমি একসময় বছরের প্রায় পুরো সময়টায় এক সময় ঢাকাতে থাকা শুরু করলাম। এমনকি ঈদের জন্যও বাড়িতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের অজুহাত খাড়া করা শুরু করলাম। সেই আমিই আবার এই বিদেশ বিভুঁইয়ে ইতোমধ্যে দুবছর পার করে দিলাম। এর মধ্যে যখন খুবই খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছি তখন শুধুমাত্র আব্বা-মায়ের কথা মনে পড়ত বা পড়ে। কিন্তু অন্য সময় বেমালুম ভুলেই থাকি। এমনকি উনাদের ফোন পেলে মাঝে মধ্যে বিরক্তও হই। কিন্তু প্রবাসী এই মানুষগুলোর আচরণ কেন জানি বারবার আব্বা-মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।

Endnotes:
  1. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/07/humanity-picture-quotes-1280x640.jpg
  2. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/07/quotes-about-humanity-and-life-18-wise-quotes-by-mark-twain-on-wisdom-human-nature-life-and.jpg

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2018/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%87-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%9c%e0%a6%a8/