দাওয়াত

by Md Yaqub Ali | March 10, 2018 12:36 am

আমাদের গ্রাম বাংলায় দাওয়াতের একটা প্রতিশব্দ ছিল জিয়াপত। দাওয়াত হোক বা জিয়াপত হোক আমার দাদি আমাকে একটা মজার জিনিস শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামে সব ধরণের দাওয়াতেই খেতে দেয়া হত কলাপাতায়। বাড়ির সামনের খোলা মাঠে যেখানে সাধারণত নবান্ন মৌসুমে ধান মাড়াই করা হত সেখানে সারি করে ধানের খড় বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হত। আর এক কোণায় কলাপাতা ধুয়ে ছোট ছোট করে কেটে স্তুপ করে রাখা হত। এরও অনেক পরে সমাজের পক্ষ থেকে টাকা তুলে টিনের প্লেট কেনা হয়েছিল। তখন কারো বাসায় কোন অনুষ্ঠান হলে সেই প্লেট মাতুব্বরের বাড়ি থেকে নিয়ে সেখানে খেতে দেয়া হত। আমরা কলাপাতা নিয়ে সারিবদ্ধভাবে খড়ের বিছানার উপর বসে পড়তাম। তারপর একে একে আসতো ভাত, তরকারি আর ডাল। আর একটা কথায় জিজ্ঞেস করতো আমিষ না নিরামিষ। তখন অবশ্য সেই কথার মানে বুঝতাম না তাই চুপ করেই থাকতাম।

দাওয়াত রেস্তোরার লোগো[1]

দাওয়াত রেস্তোরার লোগো

খাবার আসতে থাকতো আর আমরা পাল্লা দিয়ে খেয়ে চলতাম। কার চেয়ে কে কবার বেশি ভাত নিয়েছে সেটা নিয়ে আমাদের ছোটদের মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা চলতো। সবশেষে যখন ডাল দেয়া হত তখন আমি আমার দাদির দেয়া বুদ্ধি কাজে লাগাতাম। আমার দাদি আমার একজীবনে দেখা সবচেয়ে জ্ঞানী মহিলা। কথায় কথায় শ্লোক বলা ছিল উনার অভ্যাস। উনার কাছ থেকে শোনা কিছু শ্লোক আমি এখনও ভুলি নাই। যেমনঃ “বামনে বচন পড়ে, পাঁঠার লেওড়ায় শোনে” মানে হচ্ছে ভালো মানুষ তার কথাটা বলে যাবে কিন্তু খারাপ মানুষ কখনওই সদুপদেশে কর্ণপাত করবে না। আর একটা শ্লোক ছিল যেটা আমি এখনও মেনে চলার চেষ্টা করি। “দিনে খেয়ে শোই, রাতে খেয়ে চল্লিশ পা বাড়ায়। হেগে খায় খেয়ে মতে, তাকে দেখে জমে কোতে।” এর মানে হচ্ছে যে ব্যক্তি দিনের বেলায় খেয়ে একটু বিশ্রাম নেয় আর রাতের বেলায় খেয়ে একটু হাটে এবং পায়খানা করার পর খায় আর খাওয়ার পর প্রশাব করে সে অবশ্যই সুস্বাস্থের অধিকারী হবে। তার সুস্বাস্থ দেখে স্বয়ং যমদূতও ভয় পাবে।

এছাড়াও উনাকে ছাড়া পাড়ার কারো ছেলেমেয়ের বিয়ে বা মুসলমানি জমতো না। কারণ উনার গলা ছিল খুবই মিষ্টি। আর অনেক গীত জানতেন। বিয়েবাড়ি বা মুসলমানির বাড়িতে যেয়ে সুর করে গীত গাওয়ার জন্য উনাকে দাওয়াত করে নিয়ে যাওয়া হত। তারপর পাড়ার আরো অন্য মহিলারা সবাই এক জায়গায় গোল হয়ে বসে সুর করে করে গীত গাইতেন। উনি যেখানেই যেতেন আমাকে উনার সাথে নিয়ে যেতেন। তাই এই ব্যাপারগুলো আমার খুবই কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আর গীতেরও অনেক প্রকার ছিল। মুসলমানির গীত একরকম আবার বিয়ের গীত আলাদা। কলতলায় যখন গোসল দেয়া হত তার পাশেই সাধারণত গোল হয়ে বসে হলুদের গীত গাওয়া হত। আবার মুসলমানির ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা ছিল। এছাড়াও বিয়ে মুসলমানি সবগুলোতেই ক্ষীর খাওয়ার একটা চল ছিল। বিয়ের আগে বিয়ের পাত্র বা পাত্রী বাড়ির বারান্দায় বসে গোসল করে নতুন জামাকাপড় পরে বসে যেত আর পাড়ার সবাই এসে সামনে রাখা ক্ষীরের বাটি থেকে এক চামচ বা দুচামচ তার মুখে দিয়ে যারযার সাধ্যমত তার কোচের মধ্যে রাখা নতুন গামছার মধ্যে টাকা দিয়ে যেত। এছাড়াও সপ্তাহ ধরে চলতো ক্ষীর খাওয়ার উৎসব। হাতে একটা শীতল পাটি নিয়ে বিয়ের পাত্র বা পাত্রী বেরিয়ে পড়ত। সবার বাড়ি বাড়ি যেয়ে বারন্দায় বসে ক্ষীর খেয়ে আসতো। অবশ্য আগে থেকেই জানিয়ে দেয়া হত কবে উনি ক্ষীর খেতে আসবেন।

আবার দাওয়াতে ফিরে আসি। ডাল দেয়ার পরেই দাদির দেয়া বুদ্ধি অনুযায়ী আমি কলাপাতার মধ্যে ছিদ্র করে দিতাম। অবশ্য ছিদ্র করার জন্য তেমন কোন কসরত করতে হত না। শুধু আঙুলের নখ দিয়ে হালকা চাপ দিলেই কলাপাতা দুভাগ হয়ে মাঝে একটা ছিদ্র তৈরি হত। আর আমি যতই ডাল নিতাম সেগুলো ঐ ফাক গলে বেরিয়ে যেত। সব দাওয়াতে যাওয়ার আগেই আমাকে দাদি এই কুবুদ্ধি শিখিয়ে দিত। আর আমিও হাতেকলমে সেটা পালন করতাম। কিন্তু একবার বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। ডাল কলাপাতার ফাক গলে বের হয়ে আমার প্যান্টের তলা ভিজিয়ে দিয়েছিল। দাওয়াত খাওয়া শেষে সবাই আমাকে ক্ষেপাতে শুরু করলো যে আমি খেতে বসে হিসু করে দিয়েছি। কিন্তু কাউকেই আর বুঝাতে পারি নাই আসল ঘটনাটা।

বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু খাবার[2]

বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু খাবার

অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর দাওয়াত নিয়ে ছোটবেলার স্মৃতিগুলো খুবই মনে পড়তো। আমার মনে আছে কেউ দাওয়াত দিতে আসলে আমরা ছোটরা খুবই খুশি হতাম। আবার সবাই এক জায়গায় হয়ে অনেক মজা করা যাবে। ভালো-মন্দ খাওয়া যাবে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার দাওয়াতগুলো আমার কাছে রীতিমত বিভীষিকা হয়ে দেখা দিল। তাই একসময় সবরকমের দাওয়াত খাওয়া থেকে সেই সাথে দাওয়াত দেয়া থেকে নিজেদেরকে আলাদা করে ফেললাম। এইজন্য অবশ্য আমরা ইতোমধ্যেই অসামাজিক উপাধি পেয়ে গেছি। সেটা নিয়ে আমাদের কোন ক্ষেদ নেই কারণ একদিন দাওয়াত খেয়ে পরবর্তি এক মাস ধরে সেটা নিয়ে মন খারাপ করে থাকার চেয়ে অসামাজিক হয়ে থাকায় ভালো।

কিন্তু ইদানিং দাওয়াতের কথা শুনলে খুবই ভালো লাগে। সেই কারণটা বলতেই আজকের লেখার অবতারণা। দাওয়াত একটি রেস্তোরার নাম। ট্রেনে করে যাওয়া আসার পথে দেখেছি রেললাইনের সে পাশে আমাদের বসবাস তার উল্টোপাশে ইংগেলবার্ন এলাকায় দাওয়াত রেস্তোরাটি দেখা যায়। কিন্তু কখনওই খেতে যাওয়া হয় নাই। আমি এমনিতেই বাইরের খাবার খুব একটা খায় না বাড়তি খরচের ভয়ে। অবশ্য তেমন কোন উপলক্ষও তৈরি হয় নাই যে রেস্তোরাতে খেতে যাওয়া যায়। আর মনের মধ্যে এমন একটা ধারণা ছিল যদি খেতেই যায় তাহলে কেন বাঙালি রেস্তোরাতে যাবো?

কিন্তু একদিন সুযোগ এসে গেল। ব্লাকটাউনে বালির তৈরি এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড দেখে ফেরার পথে বিজয় দা আর রুপা বৌদি বললেন আমরা একটা জায়গায় যাচ্ছি দুপুরের খাবার খেতে আপনারাও চলেন। খাবার ব্যাপারে আমি কখনওই না করি না আর যদি হয় একেবারে বিনামূল্যে তাহলে তো আর কথায় নেই। উনাদেরকে অনুসরণ করে চললাম। মিনিট পয়তাল্লিশ পরে আমরা পৌছালাম দাওয়াত রেস্তোরার সামনে। রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে ভিতরে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা বড় টেবিলে আমরা সবাই একসাথে বসলাম। অবশ্য ছোট রায়ান পাশের হলরুমটাতে দৌড়াদৌড়ি করে খেলে বেড়াচ্ছিল।

এখানকার খাবার সম্মন্ধে আমাদের তেমন কোন ধারণা ছিল না তাই খাবার অর্ডারের দায়ও বর্তালো উনাদের উপর। একেবারে ষোলআনা বাঙালি খাবার অর্ডার দিলেন বৌদি। আমি মনেমনে বলছিলাম এগুলোতো বাসাতেই রান্না করে খাওয়া যায় কষ্ট করে পয়সা খরচ করে রেস্তোরাতে এসে খাবার দরকার কি? আর মনের মধ্যে সবসময় কাজ করবে স্বাদ বাসার খাবারের মত হয় নাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের অর্ডারকৃত ভাত, মুরগির মাংশ, মাছ, ভর্তা ও ডাল চলে আসলো।

বিকেলের নাস্তা[3]

বিকেলের নাস্তা

খাবারগুলো মুখে দিয়েই চমৎকৃত হলাম। খেতে খুবই সুস্বাদু হয়েছে। তাই আমরা সবাই উদরপূর্তি করে খেলাম। আর বাচ্চারা খেলো বাটার চিকেন দিয়ে ভাত। বাটার চিকেনে ঝাল কম থাকে তাই বাচ্চাদের উপযোগি সেটা। খাবার শেষ করে আমরা আরো বেশ কিছুক্ষণ ওখানে বসলাম কারণ খাবার পর এমনিতেই একটু ঝিমুনি আসে। খাবারের শেষে আমরা হাত ধুতে যেয়ে দেখলাম একটা বাটিতে পান মসল্লা রাখা। সেটা দেখে পুরান ঢাকার ঠাঠারি বাজারের ষ্টার হোটেলের কথা মনেপড়ে গেল। দাওয়াত রেস্তোরাতে দিনের তিনবেলারই খাবার পাওয়া যায়। এবং খাবারগুলো হয় খুবই সুস্বাদু এবং ফ্রেশ। এরপর আরো কয়েকবার গেছি। এবং আরো বারবার যেতে ইচ্ছে করে।

ভুরিভোজ শেষে পানমসল্লা[4]

ভুরিভোজ শেষে পানমসল্লা

আসলে ইংগেলবার্ন এবং মিন্টো এলাকাতে যে পরিমাণ বাংলাদেশি বসবাস করেন প্রত্যেকে যদি মাসে অন্ততপক্ষে একবারও যান তাহলেই কিন্তু উনারা উনাদের ব্যবসাটা টিকিয়ে রাখতে পারবেন। আমার কাছে যে ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে উনাদের ব্যবহার খুবই আন্তরিক। আর উনাদের রুচিও অনেক উন্নত। আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর দিনে বৃষ্টি হচ্ছিল তাই উনারা আমাদেরকে খিচুরি এবং বেগুনভাজি সাজেস্ট করলেন। আর তাহসান, বাপ্পা মজুমদার, হৃদয়খানের এমনসব গান ছেড়ে দিলেন যে রেস্তোরার মধ্যে একটা সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছিল। অবশ্য বিবাহবার্ষিকীর দিনেও আমাদেরকে অন্য আর একটি পরিবার ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। তাই এখন আসলে আমাদের পালা উনাদেরকে খাওয়ানোর। এবং সেক্ষেত্রে দাওয়াত রেস্তোরাই হবে আমার প্রথম পছন্দ।

Endnotes:
  1. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/03/1-1.jpg
  2. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/03/2-1.jpg
  3. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/03/3.jpg
  4. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/03/4.jpg

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2018/%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%93%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%a4/