ডেনমার্কের মিন্টু কারস্টেন ও মেলবোর্নের কামরুল চৌধুরী

by Dilruba Shahana | September 28, 2018 9:39 pm

বাস্তব কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর । সেপ্টেম্বর ২০১৮র বাংলাদেশের সংবাদপত্রের একটি খবর পাঠককুলকে আলোড়িত করে, বিস্মিত করে । খবর সামান্য তবে সময় ও স্থানের প্রেক্ষিতে এর ব্যাপ্তি ব্যাপক । সময়ের হিসাবে চল্লিশ বছর ও স্থানের মাপে তিন মহাদেশ জুড়ে ঘটনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন ।

মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পরের ঘটনা । তখনও যুদ্ধে বিধ্বস্থ দেশের সার্বিক অবস্থা তেমন ভাল নয় । পরিত্যক্ত, মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুরা তখনও ছিল সবচেয়ে অসহায় । পৃথিবীর উন্নত দেশের কিছু কিছু সংগঠন সহমর্মিতা নিয়ে মানুষের সেবায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল । এতিমখানা, দুঃস্থ শিশু ও নারী কেন্দ্র খুলে কাজ করছিল তারা । সে সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সরকার ‘পরিত্যক্ত শিশু আইন’ জারী করেন । এই আইন ছিল সময়ের প্রয়োজনে । সে আইনের আওতায় কিছু সহৃদয় ভিনদেশী ব্যক্তিবর্গ যুদ্ধশিশু ও মা-বাবাহারা শিশুদের দত্তক নিয়ে যান । পরবর্তী সময়ে এই আইন রিপীল বা বাতিল করা হয়েছিল ।

[1]

এরমাঝে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয় । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দূর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারান । রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারনে অনেকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন ।
তেমনি সময়ে ১৯৭৭সালে ঢাকাযাত্রী একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা পাবনার নগরবাড়ী ফেরীঘাটে নাস্তা করছিলেন । তার নজর কাড়ে অসহায় ছোট্ট একটি ছেলে একা একা ঘুরছে । খালি গা । গায়ে তার ঘা । হৃদয়বান সে মুক্তিযোদ্ধা শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় আসেন । তার চাচার বাসায় উঠে ছোট্ট ছেলেটিকে সাবান ডলে গোসল করিয়ে নতুন জামা প্যান্ট কিনে পরিয়ে দেন । চাচীর বদান্যতায় ক্ষুধাও নিবৃত্ত হল । এবার তাকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তরুণটি ছেলেটির জন্য স্থায়ী বাসস্থানের খোঁজে বেড়িয়ে পড়েন । যোদ্ধার অদম্য উৎসাহে শিশুটির ঠিকানা হয় টেরী ডেস হোমস পরিচালিত শিশুসদনে । শিশু সদনের একটি ফর্ম মুক্তিযোদ্ধাকে পূরণ করে দিতে হয় । কে জানতো ওই ফর্ম একদিন হয়ে উঠবে কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর জন্য এক মূল্যবান দলিল । পথশিশুকে টেরী ডেস হোমসের সদনে ঠাঁই পাইয়ে দেওয়ার অল্পদিন পরেই সেই হৃদয়বান মুক্তিযোদ্ধাও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে দেশ ছেড়ে অষ্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান ।

সেই নগরবাড়ী ঘাটে কুড়িয়ে পাওয়া ছোট্ট ছেলেকে পালক নেন এক ড্যানিস দম্পত্তি । ওই বছরই ছোট্ট মিন্টু টেরী ডেস হোমস থেকে ডেনমার্কে চলে যায় পালক পিতামাতার সাথে ।

সমৃদ্ধ দেশে হৃদয়বান মানুষের সাহচর্যে থেকে ছোট্ট মিন্টু বড় হয়ে একজন চিত্রশিল্পী বা পেইন্টার হয় । তার স্ত্রী ডাক্তার । দু’টি সন্তানও তার আছে । শেকড়ের টানে দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর মিন্টু বাংলাদেশে আসে । টেরি ডেস হোমসের এতিমখানাও আর নেই । যে আইনের বলে মিন্টু ড্যানিস পিতা-মাতার সন্তান হয়েছিল সে আইনও বাতিল । ।

শুধু তার হাতে আছে সেই সহৃদয় মুক্তিযোদ্ধার নাম ঠিকানাসহ এক টুকরা কাগজ । কাগজে লিখা নগরবাড়ী ঘাটে পরিত্যক্ত শিশুটিকে পেয়ে চৌধুরী কামরুল হোসেন নামে এক ভদ্রলোক টেরী ডেস হোমসের শিশু সদনে পৌঁছে দেন মিন্টুর সহৃদ মুক্তিযোদ্ধা হৃদয়বান ব্যক্তিটি হচ্ছেন মেলবোর্নের অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিত্ত্ব কামরুলভাই।

[2]মানুষের শোকে দুখে নিঃস্বার্থভাবে তার পাশে দাড়ানোর, কারোর আনন্দে শরীক হওয়ার উদারতা মুক্তিযোদ্ধা কামরুল চৌধুরীর সহজাত চাারিত্রিক গুণ । একা একা ঘাটে ঘুরে বেড়ানো গা জুড়ে ঘা ছোট্ট মিন্টুকে আগলে নিয়ে এসে পরম মমতায় ধুইয়ে মুছিয়ে ঠাঁই খুঁজে দেওয়ার কাজটি করতে পারেন কামরুল ভাইয়ের মত মানুষই।

[3]কামরুল ভাইয়ের স্ত্রী লায়লা চৌধুরী একজন অসাধারন মানুষ । তার উপস্থিতি সরবে উচ্চকিত নয় । চলনে বলনে ধীরস্থির লায়লা ভাবী যেন ‘আলোর পানে প্রাণের চলা’। তাঁর অনেক কথাই বলা যায় তবে লায়লা চৌধুরীকে বোঝার জন্য দু’টি মাত্র ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।

একবার এক ভারতীয় বন্ধুর নিমন্ত্রণে গিয়েছি । ওখানে সমবেতদের মাঝে আমার পরিচিতজন কম । একটি টেবিল থেকে পরিচিত মুখ অম্বলী মাসীমা ডাকলেন । তার কাছে গিয়েই বসলাম । ওই টেবিলে বসা অন্যরা জানতে চাইলেন আমি ভারতের কোন শহর থেকে এসেছি । মাসীমা হৈহৈ করে উঠলেন
‘আরে বলছো কি তোমরা? ও আমার বাংলাদেশের মেয়ে’
মাসীমা নিজে বাংলাদেশের মানুষ বিয়ে হয়েছে ভারতে । তবে বাংলাদেশের জন্য আজও তার টান গভীর । ওইদিন ওই টেবিলে বসা সবার মুখে বাংলাদেশীদের হৃদ্যতার গল্প শুনে মনটা ভরে গেল । একজন শুনালেন লায়লা চৌধুরীর এক ঘটনা।

ঘটনা হল এক তরুণ দম্পত্তি ভারত থেকে অভিবাসন নিয়ে এসেছে । ভারতের অবস্থাপন্ন শ্রেনীর মানুষ তারা । বিদেশে কষ্ট তাদের অন্যদের চেয়ে একটু বেশীই হচ্ছিল । তরুণটির চাকরি হতে দেরী হচ্ছিল দেখে তার বউ বাচ্চাসহ দেশে ফিরে যায় । তারপর পরই তরুণটির চাকরি হয় । স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বউবাচ্চাও অষ্ট্রেলিয়ায় আসার জন্য প্লেনে উঠে । দুঃখজনকভাবে যেদিন মেলবোর্নে ওদের পৌঁছার কথা সেদিন শাওয়ার করার সময়ে স্ট্রোক করে তরুণটির মৃত্যু হয় । চারপাশে সবাই হতভম্ব । কে নেবে তরুণটির শেষকৃত্যের ভার ? কাকে বলা যায় কাজটি করতে ? কে খরচ বহন করবে? ইত্যাদি প্রশ্ন যখন উঠছে কমিউনিটিতে তখন নাকি লায়লা চৌধুরী শেষকৃত্যের সমস্ত খরচ বহন করার জন্য এগিয়ে আসেন । টেবিলে সবাই বাংলাদেশের মানুষের মন অনেক বড় এসব বলাবলি করছিলেন তখন । ব্যাপারটা যে কোন বাংলাদেশীর জন্য আনন্দের ও গর্বের । লায়লা চৌধুরীর গভীর ভাল মনটির পরিচয় জানা হল ভিনদেশী ক’জন ব্যক্তির কাছ থেকে এটা কম কথা নয় ।

এর পরের ঘটনা হল আমার অভিজ্ঞা জাত । আমার বন্ধু, ছোটবোনের মত এক তরুণী কঠিন অসুখে পড়লো। অর্থবিত্ত, সফল পেশাগত জীবন, চারপাশে সহৃদয় বন্ধুবান্ধব কোনকিছুর ক্ষামতি ছিল না ওর । এখন তাকে কষ্টের মাঝে সময় পার করতে হচ্ছে । আমার মনটা ভীষন ভীষন খারাপ । এর মাঝে রোজামাস শুরু হল । মন খারাপের সেই সময়ে আমি ওর মঙ্গল চেয়ে আল্লাহ কাছে খতমে তাহলিল পড়ার জন্য প্রুতিশ্রুত হলাম । শুধু আল্লাহ নন আমার বিবেকের কাছেও আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । বন্ধুটি আমার নিজে চিকিৎসক, অর্থের ওর প্রয়োজন নাই । আল্লাহ পাকের দয়া ও সহায়তা চেয়ে অঞ্জলি পাতলাম । সোয়া লক্ষ বার দোয়াটি পড়তে হবে । এর সাথে দরুদশরীফও পড়তে হবে ।কঠিন কাজ সন্দেহ নাই । কাকে বলবো আমার সাথে পড়তে? সবাই ব্যস্ত । ওর ঘনিষ্ঠজনেরা যে যার মত করে ওর জন্য দোয়া কালাম পড়ছেন । আমার ইচ্ছা রোজার মাঝেই খতমটি শেষ করার । আমার বিপন্ন, বিষন্ন ব্যকুলতা দেখে আমার কর্মব্যস্ত কন্যারত্না বললো সেও চেষ্টা করবে কিছু তাজবীহ পড়ে দিতে ।

একদিন নিবেদিত মনে তাজবীহ জপছি তো জপেই যাচ্ছি । ফোন বাজলো । লায়লা ভাবীর ফোন । আমি ভীত ছিলাম ভেবে যে রোজার মাঝে মানত শেষ করতে পারবো কি না । খতমে তাহলীল পড়ছি শুনে লায়লাভাবী আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন উনিও এই দোয়ায় শরীক হবেন । আমি প্রতিদিন কত হাজার কে পড়েছি ডায়েরীর পাতায় তারিখ দিয়ে দিয়ে লিখে রাখতাম । লায়লাভাবী শত ব্যস্ততার মাঝেও পড়ে গিয়েছেন । কয়েক হাজার হলেই আমাকে জানাতেন । আমিও নিষ্ঠার সাথে তাজবীহর হিসাব লিখতাম । এমন কি সাহরীর সময়ও আমি কখনো কখনো লায়লা ভাবীর মেসেজ পেয়ে ডায়েরীতে তাঁর নামের পাশে তাজবীহর হিসাব লিখেছি । করুণাময়ের কৃপায় শবেকদরের(২৭শে রোজা) মাঝেই খতমে তাহলীল পড়া সম্পন্ন হল । কৃতজ্ঞ আল্লাহর কাছে যে আমার মেয়ে ও লায়লাভাবীর মতো নিঃস্বার্থ বন্ধুর সহায়তায় খতমটি নিয়ত অনুযায়ী সময়মত শেষ করা গিয়েছিল ।

কামরুল চৌধুরী ও লায়লা চৌধুরীর মতো কিছু মানুষ আছেন যারা নিভৃতে নীরবে মানুষকে সাহায্য করেই সুখী । তাদের মতো মানুষের ভাল কাজের ফলেই মিন্টুর মত স্বজনহারা বাংলাদেশের পথশিশু উন্নতদেশে মাথা উঁচু করে চলা একজন মানুষ ।

দিলরুবা শাহানা

Endnotes:
  1. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/09/2.jpg
  2. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/09/3.jpg
  3. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/09/4.jpg

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2018/%e0%a6%a1%e0%a7%87%e0%a6%a8%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a7%81-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%9f/