by Md Yaqub Ali | April 1, 2018 2:10 am
গ্রামীণ জীবনধারারর সাথে কাশফুল বা কাশবনের সম্পর্ক সেই আদিকাল থেকে। কাশের ব্যারা (দেয়াল) এবং ছাউনি দেয়া ঘর এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সরঞ্জামাদিরর মধ্যে সবচেয়ে প্রাকৃতিক। এবং এটা তার নিজের মধ্যে অনেক বাতাস ধরে রাখতে পারে বলে তাপ কুপরিবাহী হিসেবে কাজ করে প্রাকৃতিক শীতাতপ যন্ত্রের কাজ করে। গ্রামে দুই ধরণের কাশ পাওয়া যায়: একটার পাতা একটু চওড়া আর অন্যটার পাতা সরু। চওড়া পাতার কাশটাকে আমাদের গ্রামের ভাষায় বলা হত পাতিল। এর পাতা অনেক ধারালো এবং কেটে গেলে সেই ঘা সহজে সারে না। বরং সেটা পেকে গিয়ে সেখান থেকে পোজ বের হয় তারপর এক সময় শুকিয়ে যায় ঘায়ের জায়গাটা। এর কান্ডটাও একটু স্ফীত হয় আর মূল যায় মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত। তাই গ্রামে চলাচলের জন্য মাটি দিয়ে উচু করে রাস্তা তৈরি করা হয় যেটাকে বাধ বলে সেটার দুই ধার দিয়ে সারিবদ্ধভাবে এটা লাগিয়ে দেয়া হয়। এটার ফুলের ছড়াটাও অন্যটার তুলনায় একটু বেশি লম্বা হয়। এবং একটু বেশি সাদা। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এটাতে ফুল আসে। আমরা দলবেঁধে বড়দের কথা না শুনে পাতিলের পাতা ধরে কান্ডটাকে বাকিয়ে এনে কাশফুল পাড়তাম। তারপর সেটা পতাকার মত হাতে ধরে সারা পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম। এছাড়াও এই কাশের বনে খয়েরি এক ধরনের পাখি বাসা বাধতো। আমরা নজর রাখতাম কখন তারা ডিম পারে কখন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। তারপর ওদের বাসা থেকে কখনো ডিম আবার কখনো বাচ্চা চুরি করতাম।
দ্বিতীয় প্রকারের কাশকে আমরা বলতাম কাশি (বইয়ের ভাষা কাশ)। এটা সাধারণত হত গ্রামের মাঠে। আমাদের এলাকাগুলো একসময় নদীর চর ছিল তাই কোন জমি পতিত পড়ে থাকলেই সেখানে আপনা আপনি কাশবন গজিয়ে উঠতো। তবে সেগুলো দৈর্ঘে খুব বেশি বড় হত না। শৈশবে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের জন্য এই কাশবন বহুল ব্যাবহৃত হত বিশেষকরে যে সব বাচ্চা বন্ধ পায়খানায় কর্ম সারতে ভয় পেত। আর বাসায় আত্মীয় স্বজন আসলে যখন অনেক বাচ্চা কাচ্চা একসাথে হত তখন কাশবনে প্রাকৃতিক কর্মটা সারা অনেকটা উৎসবে পরিণত হত। দলবেধে আমরা বাসার সব বাচ্চাকাচ্চা কাশবনে ঢুকে একটা সুবিধামত জায়গা খুজে সেখানে সবাই গোল হয়ে বসে পড়তাম। এমনকি যাদের প্রকৃতির ডাক আসে নাই, তারাও একই ভংগিত বসে অন্যদের সংগ দিত। এছাড়াও আমরা এই কাশবন থেকে ভারই (কোয়েল) পাখির বাসা থেকে ডিম চুরি করে আনতাম। তবে এই কাশফুলগুলো সবচেয়ে ভালো হত নতুন জাগা চরে। আমাদের আগের বাড়িটা নদীগর্ভে বিলিন হয় গিয়েছিল তাই চর জাগলেই আমাদের একটা অস্থায়ি বাড়ি করা হত চরে শস্য চাষাবাদে সুবিধার জন্য। তখন নৌকা থেকে কাশের বনগুলো দেখতে দারুণ লাগতো। বিশেষকরে জোৎস্না রাত্রে এক স্বর্গিয় দৃশ্যের অবতারণা হত। আমার বেশ কয়েকবার সৌভাগ্য হয়েছে এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখার। এবং চরের এই কাশবন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অন্যতম আয়ের উৎসও তাই এটা নিয়ে চলতো কাইজা (এটা নিয়ে বিস্তারিত লিখবো অন্য কোনদিন)।
আমার মেয়ে তাহিয়া একটু বড় হবার পর থেকেই আমার সকল প্রকার পাগলামির নিত্য সহচর। তাই শরৎকাল আসলে কাশফুল জোগাড় করা আমাদের কাছে জরুরি মনেহল। ব্যাস বাপ বেটি মিলে চলে গেলাম উত্তরার পিছনে দিয়াবাড়িতে। আর হাত ভর্তি করে তুলে নিয়ে আসতাম কাশফুল। তারপর সেই কাশফুল দিয়ে আমরা বাসার বারান্দা সাজাতাম। মেয়ের মা বলতো এতে ঘর নোংরা হয়, কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাহিয়া কাশফুলকে পতাকার মত করে ধরে সারা বাড়িময় দাপিয়ে বেড়াতো। আমি সেটা দেখতাম আর মনে মনে নিজের শৈশবের দিনগুলোর কথা ভাবতাম। সেই কাশফুল তুলতে যেয়েই একদিন এক চাচার সাথে পরিচয় হল। উনি উনার গরুগুলোকে চড়াতে এনেছিলেন। আমি তাহিয়াকে বললাম দাদুর সাথে তোমার ছবি তুলে দেয়, ও সানন্দে রাজি হয়ে গেল। এভাবে দিনগুলো আমাদের ভালোই কাটছিল।
কিন্তু জীবনের গতিময়তায় একদিন অস্ট্রেলিয়া এসে হাজির হলাম আমরা বাপ-বেটি। ট্রেনে একদিন যাওয়ার পথে বাইরে কাশফুল দেখে মেয়ে বলল বাবা তুমিতো আমাকে এখনও কাশফুল এনে দাওনি। আমারও মনেহল আমরা অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছি এখানে এসে কিন্তু কাশফুল যোগাড় করা হয় নাই এখনও। তাই প্রতিবছর শরৎকাল আসলেই আমরা মনেমনে প্রতিমুহুর্ত খুজে ফিরি সাদা কাশফুল। খুজতে খুজতে গত বছর সন্ধানও পেয়েছি বেশ কয়েক জায়গায়। তার মধ্যে একটা কনস্ট্রাকশন সাইট, যেটা চারিদিকে তারের বেড়া দেয়া তাই ঢুকতে পারিনি। ট্রেনে যেতে যেতে একটা বনের (এদের ভাষায় বুশের) মধ্যে দেখলাম কাশফুল কিন্তু ওখানে কিভাবে পৌছানো যায় সেটা এখনও বের করতে পারিনি। এছাড়াও একবার দেখলাম সিডনী এয়ারপোর্টের ঠিক উল্টোপাশে বেশ কিছু কাশফুলের ঝোপ। যেখানে যাওয়ার কোন একটা রাস্তা হয়তো বের করতে পারবো। মনেমনে এমনই একটা বুদ্ধি আটতেছি যাতে তাহিয়াকে চমকে দেয়া যায়।
গত সপ্তাহে ট্রেনে করে অফিসে আসার সময় আবারো খুঁজে ফিরছিলাম কোথাও কাশফুলের দেখা পাওয়া যায় কি না? ওলাইক্রিক ষ্টেশন পার হয়ে রেললাইনের ডান দিকে ঘন বন। তাই সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলাম সেদিকে। কিন্তু আমার আশা বিফলে গেল। বনের পরে হঠাৎ দেখি রেললাইনের তারের বেড়ার সাথে একগুচ্ছ কাশফুল। দেখে এতই খুশি হলাম যে তক্ষুণি যেয়ে তুলে নিয়ে আসি। কিন্তু ডাইরেক্ট ট্রেন হওয়াতে পরের ষ্টেশনে নামা সম্ভব হল না। তাই ভাবলাম সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে এসে নিয়ে যাবো। কিন্তু মনে একটা শঙ্কা কাজ করছিল। যদি এই সময়ের মধ্যে পাশের কোম্পানির লোকজন কেটে ফেলে দেয়। কারণ কাশফুল শুকিয়ে গেলে সেটা বাতাসে ভেসে পরিবেশ নোংরা করে। তাই শনিবার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যাত্রা শুর করলাম টরেলা ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে। কাশফুলের চিন্তায় রাত্রে ঠিকমত ঘুম পর্যন্ত হল না। রাত্রে দুবার ঘুম ভেঙে গেল। তাই সকাল হতে না হতেই আর দেরি করলাম না। টোরেলা স্টেশনে যেতে হলে প্রথমে ওলাইক্রিক ষ্টেশনে যেতে হয় তারপর আবার উল্টাদিকে ফেরত এসে নামতে হয়। তাই যাওয়ার পথে আবারো কাশফুলের অবস্থানটা দেখে নিলাম। কিন্তু খারাপ লাগলো আগেরদিন এক গুচ্ছে দেখে গিয়েছিলাম কিন্তু আজ দেখলাম মাত্র একটা। ওলাইক্রিক ষ্টেশনে নেমে ফিরতি ট্রেন ধরে টোরেলা ষ্টেশনে নেমেই দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে কাশফুলের কাছে পৌছে গেলাম।
কাশফুলের কাছে পৌছে দেখি ঝাড়টা ঠিক কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে। আর অনেকগুলো ফুলের মধ্যে একটা কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলে রেললাইনের এলাকায় ঢুকে পড়েছে। তাই সেটা ছাড়া বাকি ফুলের ছড়াগুলো কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমি কাশফুলের ঝাড়টা দেখে বুঝলাম এটা আমার ছোটবেলায় দেখা পাতিল গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। পাতাগুলোর কিনার বেশ ধারালো। তবুও আমি সেই ধার উপেক্ষা করে একেবারে গোড়া থেকে ফুলের ছড়াটা ভেঙে নিলাম। পরে অনেক কসরত করে কাঁটাতারের বেড়ার উপর দিয়ে বের করে আনলাম। হাতে নিয়ে দেখলাম সবমিলিয়ে উচ্চতায় আমার চেয়ে লম্বা। তারপর সেটাকে পতাকার খুটির মত করে ধরে ষ্টেশনে চলে আসলাম। ট্রেনের দোতলায় উঠে সোজা করে ধরে রাখতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম সেটা ট্রেনের ছাদের সাথে লেগে যাচ্ছে। তাই দোতলা থেকে নেমে দুই বগির মাঝামাঝির জায়গাটাতে বসলাম। খেয়াল রাখলাম যাতে রোদ না লাগে। কারণ এই ফুল ঝাড় থেকে তুলে ফেলার পর দ্রুতই শুকিয়ে বাতাসে ভাসা শুরু করে।
তারপর মিন্টো ষ্টেশনে নেমে গাড়ির পিছনের সিয়ে কাত করে রেখে দিলাম কারণ সোজা করে রাখলে গাড়ির প্রস্থে কুলাচ্ছিল না। তারপর সরাসরি রুপা বৌদিদের বাসায়। এই মানুষটা যেকোন উপলক্ষেই ছেলেমানুষের মত খুশি হয়ে যায়। তাই কাশফুল বিষয়ে উনার উত্তেজনা অনেক বেশি ছিল। হাতের কাছে পেয়ে একেবারে বাচ্চাদের মত করে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখছিল। তারপর উনার মেয়ে এলভিরা এসেও সেটা ছুয়ে দেখলো। এরপর আমি আমাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। তাহিয়া তো কাশফুল দেখে হাজারো প্রশ্ন শুরু করলো। তারপর বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে শুরু করলো। মাঝে রায়ান এসে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছিল। আমরা কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। এরপর আমাদের প্রতিবেশী ফাহিমা এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন। উনিও আমাদের মতই অনেক বেশি খুশি হলেন। উনি সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাতে শুরু করলেন। একসময় উনার শ্বাশুড়ী সন্ধ্যা ভাবি আর মেয়ে জেইনা এসে আমাদের সাথে যোগ দিল।
একটামাত্র কাশফুলে একসাথে এতগুলো মানুষকে আনন্দ দিতে পেরেছে দেখে আমার খুবই ভালো লাগছিল। ভোরের ঘুম বাদ দিয়ে কাশফুল তুলে আনার কষ্টটাকে সার্থক মনেহচ্ছিল। প্রকৃতি আমাদের আশেপাশেই আনন্দের অনেক উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। আমরা যদি আমাদের দৃষ্টি স্মার্টফোনের স্ক্রিন থেকে একটু সরিয়ে পাশে তাকায় তাহলেই দেখতে পাবো প্রকৃতি কত উদারভাবে আমাদেরকে সুখি করার হাজারো উপকরণ সাজিয়ে রেখেছে।
Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2018/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b6%e0%a6%ab%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%96%e0%a7%8b%e0%a6%81%e0%a6%9c%e0%a7%87/
Copyright ©2024 PriyoAustralia.com.au unless otherwise noted.