কমফোর্ট জোন

by Md Yaqub Ali | August 27, 2018 7:06 pm

গুগুল ট্রান্সলেটর বলছে কমফোর্ট জোন মানে হচ্ছে সুবিধাজনক স্থান। তারমানে সোজা কোথায় বললে নিজের অনুকূল পরিবেশ। অনুকূল পরিবেশ অনেকভাবেই হতে পারে। একেবারে বস্তুগত অনুকূল পরিবেশ থেকে শুরু করে শারীরিক এমনকি মানসিক অনুকূলতাও এর অন্তর্ভুক্ত। বস্তুগত অনুকূল পরিবেশ বলতে গাড়ি, বাড়ি, পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। আর শারীরিক অনুকূল পরিবেশ বলতে উচ্চতা, উজ্জ্বল গায়ের রং সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আবার মানসিক অনুকূল পরিবেশ বলতে পারিবারিক ঐতিহ্য, শিক্ষার মান, জ্ঞান ইত্যাদিকে বুঝানো যেতে পারে।

অনেক তত্ত্বকথা বলে ফেললাম।  এইবার একটু বাস্তব উদাহরণ প্রসঙ্গে আসি।  ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে আমরা মাতৃগর্ভে অনুকূল পরিবেশে বেড়ে উঠি বলেই হয়তো আমরা এই পৃথিবীতে নিজের জন্য অনুকূল পরিবেশ খুঁজে বেড়ায়।  পরিবারে, সমাজে, জেলায়, দেশে এমনকি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে এই দূর প্রবাসেও আমরা অনুকূল পরিবেশ খুঁজে ফিরি। আমার কাছে বারবার মনেহয়েছে আমরা কেন আমাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ খুঁজে বেড়ায়। উত্তরটাও পেয়েছি হাতের কাছেই। আমরা শিক্ষায়, কর্মে, পোশাকে, আচরণে বিশ্বাসে অন্যের চেয়ে আলাদা।  তাই যতটুকু পারা যায় সেই ব্যবধান কমিয়ে মানুষের সাথে মেশার চেষ্টা করি।

[1]

পরিবারের যে মানুষটার সাথে আমাদের মতের মিল হয় না তাকে আমরা এড়িয়ে চলি। বন্ধু মহলে যাকে ভালো লাগে না তার সাথে আড্ডা দেয়া থেকে বিরত থাকি। এমনটাই স্বাভাবিক। আর ফেসবুক আসার পরে কাজটা আরো সহজ হয়ে গেছে। আমরা সমমনাদের বেছেবেছে বন্ধু বানায়। যদি বা ভুলবশতঃ ভিন্নমতের কেউ ঢুকে পড়ে তাহলে শুরুতে তাকে আনফলো তাতেও কাজ না হলে আনফ্রেন্ড। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে এন্টিবায়োটিক হিসেবে তাকে ব্লক করে দেয়। তবে ফেসবুক আসার আগেও কিন্তু এই পৃথিবীতে ভিন্নমতের লোক ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আমরা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেই কিন্তু তারা হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে না।

প্রবাসে আসার পর মানুষের মধ্যে কমফোর্ট জোনের ব্যাপারটা একেবারে প্রকট আকার ধারণ করে বিশেষকরে অস্ট্রেলিয়াতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে খুবই প্রকট। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্নভাবে মানুষ অস্ট্রেলিয়াতে এসেছে। অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকাতে করে বিভিন্ন দেশ হয়ে অবশেষে অস্ট্রেলিয়াতে এসেছে। এই ধরণের লোকেদের মধ্যে আবার চোরাগোপ্তাভাবে রোহিঙ্গারাও ঢুকে পড়েছে। এদের তেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও সততা এবং অসীম শারীরিক পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকায় তারা এদেশে টিকে আছে। কারণ এখানে সব কাজকেই কাজ হিসেবে দেখা হয় কিন্তু বাংলাদেশিদের কাছে এই শ্রেণীর মানুষগুলো কোন সম্মানতো পায়ই না বরং পদেপদে অপমানিত হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে শিক্ষিত সম্প্রদায় দেশের টাকায় পড়াশুনা করে নিজেকে দেশের তুলনায় অধিক যোগ্য বানিয়ে এই অজুহাতে দেশ ছেড়েছে যে দেশে তাদের কাজ করার সুযোগ কম। আর এই “বোট পিপল” মানুষগুলো এখানে যা আয় করেন সপ্তাহান্তে বা মাসের শেষে সেটা পুরোপুরি দেশে পাঠিয়ে দেন।

এই মানুষগুলোর বাইরে আর যেসকল বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করেন তাদের মধ্যে রয়েছে হাজারো কমফোর্ট জোন। সেটা কখনও এলাকাভিত্তিক আবার কখনও পেশাভিত্তিক বা বাংলাদেশের একই অঞ্চলভিত্তিক অথবা আত্মীয়তার সম্পর্কভিত্তিক। এক জোনের মানুষ পারতপক্ষে অন্য জোনের মানুষের সাথে মিশে না। যদি বা কদাচিৎ কোন দাওয়াতে সাক্ষাৎ হয়েও যায় তাহলে পরবর্তি দাওয়াতের সময় তারা সাবধান হয়ে যায়। এইসব জোনের মানুষদের ফেসবুকের টাইমলাইন দেখলেও বুঝা যায় তারা আলাদা আলাদা জোনের মানুষ। কারণ ফেসবুকে যখন কোন ছবি বা লেখা আপলোড করা হয় তখন শুধু নিজের কমফোর্ট জোনের মানুষদেরকেই ট্যাগ করা হয়।

অস্ট্রেলিয়াতে দাওয়াত দেয়া এবং দাওয়াত খাওয়াটা অনেকটা বাংলাদেশের সামাজিক স্ট্যাটাসের মত। কে কতজনকে দাওয়াত করে কতোবেশী পদ রান্না করে খাওয়াতে পারলো সেটা দিয়েই তাদেরকে মূল্যায়ন করা হয়। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে কিন্তু সেটা একেবারেই হাতেগোনা। আর দাওয়াতে যেয়ে কার কত দামি গাড়ি, বাড়ি আছে সেটা নিয়েই চলে আলোচনা। তাছাড়াও জীবিকা ছেলেমেয়েদের স্কুলও নির্ধারণ করে দেয় তারা সামাজিকভাবে কতটা উঁচু তলার মানুষ। কেউ যদি এই আলোচনার বিষয়বস্তুতে তাল মিলাতে না পারেন তিনি  দলছুট হয়ে  সমমানসিকতার অন্য একটা কমফোর্ট জোনে ঢুকে পড়েন।

ভিন্ন মতের ভিন্ন সামাজিক অবস্থানের মানুষদের সাথে না মিশে আমরা আমাদের কমফোর্ট জোনে সুখে শান্তিতে বসবাস করি। কিন্তু আমরা ভুলে যায় আমরা একই জেলা বা দেশের বা আরো বৃহত্তর অর্থে একই পৃথিবীর বাসিন্দা। তাই অন্যদের সাথে মেশার দায়িত্ত্বটা আমরা যারা নিজেদেরকে শিক্ষায়, পেশায়, পোশাকে, কর্মে উন্নত প্রজাতির ভাবি তাদেরকেই নিতে হবে। ফেসবুক আসাতে অনেক খারাপ জিনিসের সাথে অনেক ভালো জিনিসও আমরা মুহূর্তের মধ্যে জেনে যাচ্ছি।  ফেসবুকের ভালো জিনিসগুলোকে আমরা বাহবা দিচ্ছি আর খারাপ জিনিসগুলোকে নিয়ে নাক সিটকাচ্ছি। ফেসবুকের মাধ্যমে সকল শ্রেণীপেশার মানুষ সহজেই নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। তাই আমরা সহজেই বুঝতে পারছি যে এই পৃথিবীতে বহু ভাবনার লোক বসবাস করে।

এইবার আসি বিশ্বায়নের দিকে। প্রযুক্তি যেমন মানুষের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে ঠিক তেমনি তার হাত ধরেই এসেছে বিভিন্ন রকমের মারণাস্ত্র। আর মারণাস্ত্রের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্যই সেগুলোর প্রয়োগ করে তার চাহিদা ধরে রাখা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। আর তার জন্য গিনিপিগ বানানো হচ্ছে মানুষকে। বিভিন্ন অজুহাত তুলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের উপর মারণস্ত্রগুলো সময়ে সময়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে। যার হাত থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কেউই রেহাই পাচ্ছে না। আর এই অজুহাতগুলোই তরি করা হচ্ছে বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তিতে। প্রথমে একদল দুর্বল এবং নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠির হাতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তুলে দেয়া হচ্ছে এই মারণাস্ত্র। তারপর তাদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ধ্বংস করার নামে আবার একই মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে।

এমতাবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধমগুলোতে এইসমস্ত ঘটনার পক্ষে এবং বিপক্ষে মতামত তৈরি হচ্ছে এবং সেটা প্রত্যেকে ব্যক্তও করছেন নির্দ্বিধায়। যারফলে প্রত্যেকেরই মনের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে এই মাধ্যমগুলোতে। সেটার উপর ভিত্তি করেই তার পরিচিত বা বন্ধুমহল তাকে নিজেদের বলয় থেকে বাদ দিচ্ছেন না যোগ করে নিচ্ছেন। যাতেকরে নিজেদের কমফোর্ট জোনের শান্তি যেন না নষ্ট হয়। প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এখানে ধর্মকর্ম থেকে শুরু করে সবকিছুতেই অবারিত স্বাধীনতা। তাই সবার যারযার মতামত নিঃসংকোচে প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছে যারফলে দ্রুতই তার মানসিকতা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। সেটার ভিত্তিতেই তখন তিনি কোন একটা কমফোর্ট জোনে ঢুকে পড়ছেন।

বিশ্বায়নের এই যুগে সমগ্র পৃথিবী এখন একটা গ্রাম। তাই পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের মানুষের সমস্যা হলে অন্য প্রান্তের মানুষ এখন আর তার কমফোর্ট জোনে সুখে শান্তিতে বসবাস করার উপায় নেই। কোন না কোনভাবে সেই সমস্যা অন্য প্রান্তের মানুষকে স্পর্শ করবেই। তাই নিজের পরিবারের, সমাজের, দেশের মানুষ সুখে শান্তিতে আছে অন্যের কি হল সেটার খোঁজ আমার রাখার দরকার নেই এমন মনোভাব নিয়ে চলার দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। ভিন্নমতের মানুষকে এড়িয়ে না চলে বরং তাদের সাথে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীটাকে আমরাই পারি মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে। নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে ভিন্নমতের মানুষকে আমরা যতদ্রুত স্বীকার করে নিতে পারবো ততই মঙ্গল।

Endnotes:
  1. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/08/n-COMFORT-ZONE-628x314.jpg

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2018/%e0%a6%95%e0%a6%ae%e0%a6%ab%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%9f-%e0%a6%9c%e0%a7%8b%e0%a6%a8/