by Afzal Hossain | March 22, 2018 10:12 pm
অষ্ট্রেলিয়ার কোন জায়গা, স্থাপত্য কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা অথবা উপভোগ করার জন্য সবচেয়ে বেশি সংখ্যক স্বদেশ-বিদেশের পর্যটক এবং দর্শনার্থীরা পরিদর্শন করে ?
জানি, অনেকেই ঝটপট বলবেন সিডনির হার্বার ব্রীজ বা অপেরা হাউজ, ক্যানবেরার পার্লামেন্ট হাউজ, কুইন্সল্যান্ডের গোল্ডকোস্ট বা গ্রেট বেরিয়ার রীফ, এমনকি মধ্য-অষ্ট্রেলিয়ার উলুরুতে অবস্থিত আয়ার্স রকের কথাও বলতে কসুর করবে না । কিন্তু বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি দেশি-বিদেশি পর্যটক এবং দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটেছে ক্যানবেরা শহরের আইন্সলি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত অষ্ট্রেলিয়ান ওয়ার মেমোরিয়ালে । পাথরের তৈরি এই মেমোরিয়ালে শুধু ২০১৫ সালে প্রায় বারো লক্ষ পর্যটক পরিদর্শন করেছে । বর্তমান সময়ে মানুষের তৈরি স্থাপত্যের মধ্য বিশ্বের তেইশতম স্থান দখল করে আছে ১৯৪১ সালে নির্মিত এই ওয়ার মেমোরিয়াল ।
মূল লেখায় যাওয়ার আগে যুদ্ধ সম্পর্কে দু’চারটি কথা বলার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না । লেখার বিষয় নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একত্রিশতম প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুবার্ট (১৮৭৪-১৯৬৪)-এর কথাটা মনে পড়ে । তিনি বলেছেন, ‘বুড়োরা যুদ্ধ শুরু করে, কিন্তু যুবকরাই যুদ্ধ করে এবং নিহত হয় ।’ তবে মার্কিন সামরিক জেনারেল উইলিয়াম ওয়েষ্টমোরল্যান্ড (১৯১৪-২০০৫) নিজেদের, অর্থাৎ সেনাবাহিনীকে,গা বাঁচিয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘সামরিক বাহিনী যুদ্ধ শুরু করে না, করে রাজনীতিবিদরা ।’ যাহোক, যুদ্ধ যেই শুরু করুক বা সরাসরি অংশগ্রহণ করুক, কবি হেলাল হাফিজের কাছে যুদ্ধের সংজ্ঞা আলাদা । তিনি মনে করেন, ‘যুদ্ধ মানেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, যুদ্ধ মানেই আমার প্রতি তোমার অবহেলা ।’ আসলেই যুদ্ধের নেপথ্যে থাকে স্বার্থ, মোহ, জিঘাংসা, আধিপত্য বিস্তার করার নষ্ট মানসিকতা এবং অন্যের প্রতি তীব্র অবহেলা বা ঘৃণা । অন্যদিকে বিশ্বনন্দিত ব্যাঙ্গাত্বক উপন্যাস ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’-এর রচয়িতা আইরিশ লেখক জোনাথান সুইথট্ (১৬৬৭-১৭৪৫)-এর ভাষায় ‘যুদ্ধ ! সে তো পাগলা খেলা, বিশ্ব যে খেলা খেলতে অত্যন্ত ভালোবাসে ।’ এ কথা সত্যি যে, মানব সৃষ্টির পর থেকে আজ অবধি এই খেলায় যে কত প্রাণ ঝরে গেছে, তার কোন সঠিন পরিসংখ্যান নেই । তবে যুদ্ধে, যে কারণেই হোক না কেন, নিহতদের প্রতি পরবর্তী প্রজন্মদের একধরনের ঋণ থেকেই যায় । আর এই ঋণ খানিকটা পরিশোধ করার জন্য আমরা নির্মাণ করি ওয়ার মেমোরিয়াল । এছাড়া ইহলোকের ওয়ার মেমোরিয়াল বা মনুমেন্টে আমরা পরলোকবাসি সৈনিকদের জীবনবৃত্তান্ত জানতে এবং তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাতে যাই ।
বিগত চৌত্রিশ বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অতিথিদের নিয়ে আমি কতবার যে অষ্ট্রেলিয়ান ওয়ার মেমোরিয়ালে গিয়েছি, তার কোন হিসাব-নিকাশ নেই । তবে হলফ করে বলতে পারি নিদেন হলেও কুড়ি বার তো হবেই আমি ওয়ার মেমোরিয়ালে গিয়েছি । প্রতিবার ঘন্টা চারেক কিংবা তারচেয়ে বেশি সময় খরচ করেছি এবং পাখির খুদ খাওয়ার মতো ঝটপট প্রদর্শনী সামগ্রী (ডিসপ্লে অবজেক্ট) দেখেছি । কখনই পুরোটা একসঙ্গে দেখা হয়নি । তবে সাধারণ অংকের হিসাবে কুড়ি গুণ চার ঘন্টা সমান মোট আশি ঘন্টা হয় । অবশ্য এই আশি ঘন্টায় পুরো এলাকা ঘুরে দেখা যাবে, কিন্তু প্রতিটি প্রদর্শনী সামগ্রী মনোযোগের সঙ্গে খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব নয় । বাইরে থেকে দেখলে কিছুতেই ঠাহর করা যাবে না যে, বিল্ডিংয়ের ভেতর দর্শনার্থীদের চমক দেয়ার মতো কী বিচিত্র জগত সুন্দর এবং পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে । যাহোক, এই লেখায় আমি বিভিন্ন সময়ে যাওয়া আমার অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি ।
ওয়ার মেমোরিয়ালের মূল প্রবেশ পথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই সামনে পড়ে খোলা আকাশের নিচে ‘কম্যামোরেটিভ কোর্টইয়ার্ড’ । এই কোর্টইয়ার্ডের মাঝখানে রয়েছে আয়তক্ষেত্রাকার আকৃতির জলাধার, যা ‘পুল অফ রিফ্লেকশন’ নামে পরিচিত । মজার ব্যাপার হলো এই জলাধারের মেঝেতে স্ফটিক পানির মধ্যে দিনের উজ্জ্বল আলোয় বিভিন্ন আকৃতির সোনালি এবং রূপালি রঙের খুচরো পয়সা চিকমিক করে । দর্শনার্থীরা সেখানে পয়সা ফেলে । যদিও বিশাল সমুদ্রের বুকে এক বালতি পানির মতো তুচ্ছ, তবুও পরে কর্তৃপক্ষ সেগুলো সংগ্রহ করে এবং মেমোরিয়ালের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ব্যবহার করে । আসলে মুদ্রার পরিমাণ মূল বিষয় নয়, আসল কথা হলো পর্যটক এবং দর্শনার্থীদের ইমোশনকে শ্রদ্ধা করা । প্রথমবার দেখে আমি তো রীতিমতো আশ্চার্য্যন্বিত । এত্তো পয়সা জমা হয়েছে, অথচ কেউ হজম করেনি ! যাহোক, জলাধারের শেষ প্রান্তে আছে অনির্বাণ শিখা বা শিখা চিরন্তন । এছাড়া জলাধারের দুপাশে কংক্রিটের হাঁটা পথ এবং তারপরে আছে রোজমেরি গুল্ম আচ্ছাদিত খানিকটা জায়গা ।
‘কম্যামোরেটিভ কোর্টইয়ার্ড’-এর উপরের তলার দুপাশের সমান্তরাল দীর্ঘ বারান্দাকে বলা হয় ‘রোল অফ অনার’ । এ প্রসঙ্গে পরে আসছি । ‘কম্যামোরেটিভ কোর্টইয়ার্ড’ পেরিয়ে সামনের দিকে সামান্য এগোলেই উপরের তলায় রয়েছে ওয়ার মেমোরিয়ালের হৃদপিন্ড নামে পরিচিত ‘হল অফ মেমোরী’ । এই হল অফ মেমোরীর উদ্বোধনের কথা ছিল ১৯৪১ সালে । কিন্তু সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় । যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, হল অফ মেমোরীকে যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের উৎসর্গ করা হবে এবং পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে তাই করা হয়েছে ।
যাহোক, বর্তমানে হল অফ মেমোরীর গোলাকৃতি ঘরের মাঝে মোজাইক করা মেঝেতে রয়েছে আননোন সোলজার বা অজ্ঞাত সৈনিকের সমাধি । সেখানে ১৯৯৩ সালের আগে কিছু ছিল না । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পঁচাত্তরতম পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৩ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের অ্যাডেলেইড কবরখানা থেকে অজ্ঞাত সৈনিকের কংকাল এবং মাটি তুলে এনে হল অফ মেমোরীর গম্বুজের সরাসরি নিচে মেঝের মাঝখানে সমাহিত করা হয় । বিভিন্ন যুদ্ধে এবং নানান ধরনের সংঘর্ষে যেসব অষ্ট্রেলিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছে, তাদের সবার প্রতীক হিসাবে অজ্ঞাত সৈনিককে গণ্য করা হয় । বিশাল একখন্ড লাল মার্বেল পাথরের ফলক দিয়ে পুরো সমাধি ঢাকা । এই লাল পাথর কালো গ্রানাইটের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে । মেঝে থেকে সমাধির উপর পর্যন্ত চারপাশে মার্বেল পাথরের ঢালু, যা জীবিত এবং মৃত সৈনিকের আলাদা ভুবনের পার্থক্য বোঝানো হয়েছে । উপরের পাথরের সোনালি অক্ষরে খোদাই করে লেখা: ‘An unknown Australian Soldier killed in the war of 1914-1918’, অর্থাৎ ‘১৯১৪-১৯১৮-এর যুদ্ধে নিহত অষ্ট্রেলীয় অজ্ঞাত সৈনিক’ । মাথার দিকে মার্বেল পাথরের উপর লেখা: ‘Known unto God’ (‘ঈশ্বরের কাছে পরিচিত’) এবং পায়ের দিকে লেখা: ‘He is all of them and he is one of us’ (‘তিনি সবাই এবং তিনি আমাদের মাঝে একজন’) ।
হল অফ মেমোরী অষ্টভূজ আকৃতির এবং মাঝখানে অজ্ঞাত সৈনিকের সমাধির উপরে রয়েছে বাইজেনটাইন স্টাইলে কারুকাজ করা গম্বুজ । চব্বিশ মিটার উঁচু সিলিংয়ের কারুকাজের দিকে তাকালে অনায়াসে যে কারোর দৃষ্টি চলে যাবে উপরের দিকে । নীচ থেকে উপরের দিকে তাকালে দেখা যায় প্রসারিত হাত যেন ধূসর মেঘ এবং গাঢ় নীলাকাশ পেরিয়ে মৃতদের আত্মা পৌঁছে দিচ্ছে স্বর্গে । গম্বুজে অংকিত ডানাওয়ালা কফিনের ছবি মিশরীয় মমির কথা মনে করিয়ে দেয় ।
হল অফ মেমোরীর তিন পাশে (পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিক) রয়েছে রং-বেরঙের স্টেইন্ড-কাঁচের জানালা এবং প্রতিটি জানালায় আছে পাঁচটি করে প্যানেল । প্রতিটি প্যানেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক একজন সৈনিকের পোশাক এবং আগ্নেয়াস্ত্র সহ ছবি আছে । এসব ছবির মাধ্যমে যুদ্ধের ময়দানে সাহসী সৈনিকদের বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট তুলে ধরা হয়েছে । যেমন দরজা দিয়ে ঢোকার পর বাম পাশের (পশ্চিম দিক) জানালা সামাজিক বৈশিষ্ট, উল্টোদিকের (দক্ষিণ দিকের) জানালা ব্যাক্তিগত বৈশিষ্ট এবং ডান পাশের (পূ্র্ব দিকের) জানালা যুদ্ধের বৈশিষ্ট চিহ্নিত করে । এছাড়া চার কোণার দেয়ালে রঙিন কাঁচের অংকিত নাবিক, রণাঙ্গণের সহযোগী নারীকর্মী, সৈনিক এবং বৈমানিকের অবয়বের চিত্র রয়েছে । উল্লেখ্য, হল অফ মেমোরীর ভেতর ইচ্ছে মতো ছবি তোলা যায়, কিন্তু শব্দ করে মৃত সৈনিককে কিছুতেই জাগানো যাবে না ।
হল অফ মেমোরী থেকে বেরিয়ে ডানে অথবা বামে দীর্ঘ বারান্দা দিয়ে আসতে হয় । দুপাশের বারান্দাই হলো ‘রোল অফ অনার’ । দুদিকের বারান্দার দেওয়ালে ব্রোঞ্জের ফলকের উপর এক লক্ষ দু’হাজারেরও বেশি বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত সৈনিক এবং রণাঙ্গণের সহযোগী নারী-পুরুষ কর্মীদের নাম খোদাই করে লেখা আছে । নামের সঙ্গে নিহতদের কোন পদবী কিংবা অ্যাওয়ার্ডের কথা উল্লেখ করা নেই । কেননা কর্তৃপক্ষ মনে করে যে, মৃত্যুর পরে সবাই সমান । যাহোক, বৃটিশদের সুদান অভিযান (১৮৯৬-১৮৯৯), দ্বিতীয় বোয়্যার যুদ্ধ (১৮৯৯-১৯০২) এবং বক্সার বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০১) থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ের দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘর্ষে নিহত সৈনিকদের নাম আছে । তবে পশ্চিম দিকের দেয়ালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত ষাট হাজার সৈনিকের নাম এবং পূর্ব দিকের দেয়ালে দ্বিতীয় ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংঘর্ষে নিহতদের নাম লেখা আছে । সেই সব সৈনিকদের উত্তরসূরীরা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব বিশেষ দিনে গিয়ে নামফলকের পাশে ছোট্ট জায়গায় প্লাস্টিকের লাল রঙের পপি ফুল রেখে যায় । সেদিন তারা পূর্বসূরীদের ত্যাগ স্মরণ করে এবং শ্রদ্ধা জানায় । কর্তৃপক্ষ শুধু মাত্র নামফলক পরিস্কার করার সময় পপি ফুল সরিয়ে ফেলে । অন্যথায় তারা ফুল সরানোর জন্য কোন উদ্যোগ নেয় না । যাহোক, প্রথমবার বেশুমার ফুল দেখে আমার মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উঁকিঝুকি দিয়েছিল । প্রশ্নটা ছল এধরনের: অন্য কোন ফুল নয়, অন্য রং নয়, এমনকি তাজা ফুলও নয়, শুধু প্লাস্টিকের লাল পপি ফুল রাখার কারণ কী ? আমি পরে খুঁজে বের করেছি । চৌত্রিশ বছর আগে তো আর ব্রাদার গুগোল ছিল না । তাই আমাকে বিভিন্ন পুস্তকের শরণাপন্ন হতে হয়েছে । যেটুকু তথ্য খুঁজে পেয়েছি, অতি সংক্ষেপে তা হলো: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দক্ষিণ ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের বিধ্বস্ত রণক্ষেত্রে সর্বপ্রথম পপি ফুল প্রস্ফুটিত হয়েছিল । তখন সহযোদ্ধারা নিহতদের পপি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল । সেই থেকে পপি ফুল নিহত সৈনিকদের শ্রদ্ধা জানানো এবং স্মরণ করার প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । উল্লেখ্য, সহযোদ্ধাদের মাঝে প্রচলিত ছিল যে, লাল রঙ নিহতদের রক্তের প্রতীক । কেননা নিহত সৈনিকেরা নির্ভয়ে তাদের বুকের রক্ত দান করেছে । এছাড়া পপি ফুলকে ঘুমের প্রতীক হিসাবেও গণ্য করা হয় ।
রোল অফ অনার থেকে বেরিয়ে এসে ডান দিকে রয়েছে মূল ভবনের পশ্চিম গ্যালারীতে ঢোকার প্রবেশ পথ । দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ও্যরিয়েন্টেশন্ গ্যালারীতে সিকিউরিটির কাছে ব্যাকপ্যাক জাতীয় ব্যাগ রেখে যেতে হয় । যেহেতু ভেতরে কোন গাইড নেই, তাই সবকিছু নিজের মতো করে দেখার জন্য পুস্তিকা নিয়ে প্রবেশ করাই সমুচিত । তাতে দেখাটা অনেক সহজ হয় এবং বহুদিন মনের গভীরে জমা হয়ে থাকবে । ও্যরিয়েন্টেশন্ গ্যালারী পেরোলেই দেখা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গ্যালারী । সেখানে ডিসপ্লে অবজেক্ট, অর্থাৎ প্রদর্শনীর সামগ্রীগুলো সাজানো হয়েছে বিভিন্ন যুদ্ধে অষ্ট্রেলিয়ার প্রথম অংশগ্রহণের কালক্রম অনুযায়ী । এসব সামগ্রী বড় বড় ঘটনার সাক্ষী, যেমন গ্যালিপলির যুদ্ধ, ওয়েষ্টার্ণ ফ্রন্ট বা পশ্চিম রণাঙ্গণ, সিনাই এবং প্যালেস্টাইনে যুদ্ধ । এছাড়া সমুদ্রে যুদ্ধেরও সামগ্রী রয়েছে । বলা হয়, বিশ্বের অন্য সব দেশের জাদুঘর থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সামগ্রীর সংগ্রহ এই গ্যালারীতে । এতে রয়েছে ডাইয়োরামা বা পিকচার মডেল এবং অন্যান্য শিল্পকর্ম, সৈনিকদের পোশাক, মেডেল, যুদ্ধের সরঞ্জাম, যেমন আগ্নেয়াস্ত্র, কামান, মেশিনগান, বন্দুক, গ্রেনেড, যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি এবং সৈনিকদের ব্যাক্তিগত জিনিসপত্র, যেমন চিঠি এবং দিনলিপি । সেখানে গোটা দশেক পিকচার মডেল আছে । প্রায় সবগুলোই ফ্রান্সের বিভিন্ন রণক্ষেত্রের, যেখানে অষ্ট্রেলিয়ার সৈনিকেরা যুদ্ধ করেছে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গ্যালারী বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত । মাঝখানে খানিকক্ষণ বসে জিরিয়ে নেয়ার জন্য বেঞ্চ পাতা আছে । সেখানে বসে শুধু বিশ্রাম করা নয়, বরং যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তার ফুরসৎ পাওয়া যায় । তবে বসার জায়গা কেবল এই ওয়েষ্টার্ণ ফ্রন্ট গ্যালারীতেই নয়, পুরো ভবন জুড়েই রয়েছে । কেননা অনেক বুড়ো-বুড়ির উপস্থিতি দেখেছি । তারা হয়তো তাদের পড়ন্ত বেলার অফুরন্ত সময় কাটাতে আসে, অথবা যুদ্ধের ভয়াবহতা জানার এবং উপলব্ধি করার জন্য আসে, কিংবা নিজের শেকড় চেনার জন্য আসে । তবে যেকারণেই আসুক না কেন, নিশ্চয়ই তাদের ভেতর নিহত সৈনিকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রয়েছে ।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ওয়ার মেমোরিয়ালের ভান্ডারে প্রচুর সংখ্যক দূর্লভ প্রদর্শনী সামগ্রী সংগ্রহ আছে । সেগুলো পর্যায়ক্রমে প্রদর্শন করা এবং দর্শকদের একঘেয়েমী দূর করার জন্য ‘অ্যানজাক’ [ANZAC – Australia and New Zealand Army Corps] দিবসে, অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল, অনেক অস্থায়ী প্রদর্শনী সামগ্রী পরিবর্তন করা হয় । যেমন আমি কয়েক বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ গ্যালারীতে দেখেছি ‘ম্যান ইন দ্য মাড’ ডাইয়োরামা, যা আমার অত্যন্ত পছন্দনীয় ছিল । একজন হতাশাগ্রস্থ সৈনিক রণাঙ্গণে কাঁদার মধ্যে বসে দুহাতে মুখ ঢেকে আছে । ডাইয়োরিমা, অর্থাৎ পিকার মডেলটি এত বেশি বাস্তব ছিল যে, নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমি তো প্রথমবার চুপিচুপি আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে দেখিছি কাঁদা আসল, নাকি নকল । আসলে সেটি ছিল অত্যন্ত নিঁখুত ভাবে কাঁদা মাটির রঙের কাঁচের তৈরি । আরেকটা আইটেম আমি আমার অতিথিদের বিশেষ আগ্রহ নিয়ে দেখাতাম । সেটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গ্যালারীতে । সে প্রসঙ্গে পরে আসছি ।
যাহোক, একসময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রদর্শন দেখে সামনে ‘হল অফ ভ্যালোর’-এর দিকে এগিয়ে যাই । যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব ও সাহসিকতার সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ভিক্টোরিয়া ক্রশ’। অষ্ট্রেলিয়ার সৈনিকরা সর্বমোট ১০০টি ‘ভিক্টোরিয়া ক্রশ’ অর্জণ করে, যার মধ্যে ছিয়ানব্বইটি ইম্পেরিয়াল ‘ভিক্টোরিয়া ক্রশ’, যা ১৯৭৫ সালের পূর্বে বৃটিশ রাজতন্ত্র কর্তৃক প্রদত্ত এবং বাকি চারটি পরবর্তীতে অষ্ট্রেলিয়ার সরকার কর্তৃক প্রদত্ত । এগুলোর মধ্য ৭৬টি রাখা হয়েছে হল অফ ভ্যালোরে । বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ‘ভিক্টোরিয়া ক্রশ’-এর সংগ্রহ এই হল অফ ভ্যালরে । উল্লেখ্য, তৎকালীন বৃটিশ অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে সৈনিকদের বীরত্ব এবং সাহসিকতার জন্য এই মেডেল প্রদান করা হয় । যদিও বৃটেনের রানী ভিক্টোরিয়া ১৮৫৬ সালে এই মেডেল প্রবর্তন করেন, কিন্তু ক্রিমিয়ার যুদ্ধ অন্তর্ভূক্ত করার জন্য ১৮৫৪ সাল থেকে প্রদান করা হয় । বোয়্যার যুদ্ধে বীরত্ব এবং সাহসিকতার জন্য ১৯০০ সালে প্রথম অষ্ট্রেলিয়ান হিসাবে ইম্পেরিয়াল ‘ভিক্টোরিয়া ক্রশ’ অর্জণ করেন ক্যাপ্টেন স্যার নেভিল হাউজি । অন্যদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের জন্য ১৯৭০ সালে সর্বশেষ ইম্পেরিয়াল ‘ভিক্টোরিয়া ক্রশ’ অর্জণ করেন ওয়ারেন্ট অফিসার কীথ্ পাইন । অষ্ট্রেলিয়া সরকার কর্তৃক প্রথম ‘ভিক্টোরিয়া ক্রশ’ অর্জণ করেন কর্পোরাল মার্ক ডোনাল্ডসন (২০০৯ সালে) এবং শেষ পুরস্কার পান (মরনোত্তর) কর্পোরাল ক্যামারন বেয়ার্ড (২০১৪ সালে) । টেলিভিশনে দেখা অনুষ্ঠান দুটি এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে ।পরবর্তী দর্শনীয় জায়গা হলো এয়ারক্রাফট্ হল । এয়ারক্রাফট্ হলের নাম দেখেই বোঝা যায় ভেতরে কী আছে । হ্যাঁ, প্রদর্শনীর জন্য এই হলের ভেতর স্থায়ী ভাবে বেশ কয়েকটি ক্লাসিক যুদ্ধবিমান আছে, যেমন মসকুইটো, কিটিহক, মাসটাং, সী ফিউরি, মিগ-১৫ এবং জাপানী অস্কার ছাড়াও আরো কয়েক ধরনের যুদ্ধবিমান রয়েছে । এসব বিমান ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং কোরিয়ান যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল । সবচেয়ে আকর্ষণীয় আইটেম হলো বিশাল পর্দায় গ্রাফিক্স, অডিও-ভিজ্যুয়াল, লাইটিং এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে বিমান যুদ্ধ দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে । অনেক জিরিয়ে নেবার ফাঁকে পাঁচ-দশ মিনিট বসে । আমিও অতিথিদের নিয়ে বসে পরবর্তী দর্শনীয় বিষয়ের উপর সামান্য জ্ঞান বিতরণ করি ।
আমাদের পরবর্তী আকর্ষণ ছিল ওয়ার মেমোরিয়াল ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরের শেষ দিকে বিশাল এলাকা জুড়ে ‘অ্যানজাক’ হল । এয়ারক্রাফট্ হল থেকে বেরিয়ে কাঁচে ঢাকা সরু বারান্দা পেরোলেই ‘অ্যানজাক’ হল । আয়তনের দিক থেকে এই হল এতই বড় যে বিখ্যাত ল্যাঙ্কাস্টার বোমারু বিমান ‘জি ফর জর্জ’ সহ নিদেন হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোটা দশেক যুদ্ধ বিমান, এমনকি একটা টর্পেডোও সুন্দর এবং পরিকল্পিত ভাবে সাজিয়ে রেখেছে । হলের ভেতর আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলা, কেমন যেন গা ছমছম পরিবেশ । বড় স্ক্রীনে বিমান আক্রমণ এবং কামান ও বন্দুকের গুলির দ্রুম দ্রুম দ্রিম দ্রিম শব্দের সংমিশ্রণে প্রদর্শিত হয় যুদ্ধের বাস্তব চিত্র । সেখানে আরো আছে ক্ষতিগ্রস্ত টর্পেডো । এছাড়া সেই হলের একাংশ জুড়ে শব্দ এবং আলোর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেখানো হয় ১৯৪২ সালে সিডনি পোতাশ্রয়ে জাপানী সাবমেরিনের প্রবেশ, যার শিরোনাম ‘সিডনী আন্ডার অ্যাটাক’ । সিডনী পোতাশ্রয়ের নীল পানি এবং ঢেউয়ের সাদা ফেনা এতই নিঁখুত ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, সামনে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হয় সেই মুহূর্তে সত্যি যেন চোখের সামনে ঘটনা ঘটছে ।
যেহেতু ‘অ্যানজাক’ হলের অবস্থান গ্রাউন্ড লেভেলের শেষ মাথায়, তাই গ্রাউন্ড লেভেলের মাঝামাঝি জায়গায় এসে সিঁড়ি বেয়ে [অবশ্য লিফটের ব্যবস্থা আছে] নিচে নামতে হয় । নিচের তলায় বা আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরে, যেতে হলে সাধারণ দর্শনার্থীদের এ পথেই যেতে হয় । সেখানে রয়েছে আরেক বিচিত্র জগত ।
‘Conflicts 1945 to today’ গ্যালারীতে ১৯৪৫ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অষ্ট্রেলিয়ার সৈন্যরা বিভিন্ন যুদ্ধে, যেমন কোরিয়া এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে সৈনিকদের অংশগ্রহণের অনেক আইটেম । এছাড়া সেখানে ১৯৪৭ সাল থেকে শান্তি রক্ষা বাহিনীর সদস্য হিসাবে অংশগ্রহণ করার বিভিন্ন সামগ্রী প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে । এক পাশে মিডল ঈষ্ট গ্যালারীতে আছে প্রথম গালফ্ ওয়ার, মেরিটাইম ইন্টারসেপ্ট ইন্সপেকশন, ইরাক এবং আফগানিস্তান যুদ্ধের আইটেম ।
‘অ্যানজাক’ হল থেকে বেরোনোর পর রয়েছে ‘Bridge of HMAS Brisbane’, যা ‘Conflicts 1945 to today’ গ্যালারীর শেষ দিকে অবস্থিত । কাঁচ দিয়ে ঘেরা সরু পথ দিয়ে সেখানে যেতে হয় । আমি দুবার সেই সেই সরু পথ পেরিয়ে ব্রীজের ভেতর ঢুকেছিলাম । রীতিমতো অবাক করার মতো পরিবেশ । সামনে দাঁড়ালে মনে হয় যেন বিশাল সমুদ্রের নীল পানির বুক চিরে আরো যুদ্ধ জাহাজ ধেয়ে আসছে । মাঝে মাঝে কামান দাগার বিকট শব্দ । মনে হয় যেন আমাদের জাহাজকে আক্রমণ করছে এবং আমরা জলযুদ্ধের এক একজন নির্ভীক সৈনিক । উল্লেখ্য, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং শেষে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বহুজাতিক কাজে HMAS Brisbane-কে ব্যবহার করা হয়েছে ।
‘ভিসকোভারী জোন’ বা ‘এডুকেশন সেন্টার’-এ যুদ্ধ বিষয়ক, বিশেষ করে বিভিন্ন যুদ্ধে অষ্ট্রেলিয়ার অংশগ্রহণের উপর, গবেষণা করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে তথ্য পাওয়া যায় । অবশ্য আমি কখনই ভেতরে প্রবেশ করিনি । তবে একবার উঁকি দিয়েছিলাম । নীচের তলায় আরো আছে ‘স্পেশল্ এক্সইবিশনস্ গ্যালারী’, ‘থিয়েটার’ এবং ‘কলোনিয়াল কনফ্লিক্টস্’ ।
নিচ তলা থেকে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি বেয়ে উপরে পূর্ব দিকে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গ্যালারী । আগেই উল্লেখ করেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গ্যালারীতে আমি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে অতিথিদের একটা আইটেম দেখাতাম । অবশ্য এখন সেটা আর নেই, সরিয়ে ফেলেছে । যাহোক, সেটা ছিল আনবিক বোমার আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হিরোশিমা শহরের ধ্বংসাবশেষ । চীনা মাটির চায়ের কাপ ও পিরিচ, কাঁচের গ্লাস এবং স্টেইনলেস স্টীলের চামচ প্রচন্ড উত্তাপে গলে এক সঙ্গে একটা পিন্ড তৈরি করেছে । শুধুমাত্র আমি সেটি দেখেই আনবিক বোমার ভয়াবহতা এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সামান্য হলেও উপলব্ধি করতে পারতাম । কী বিভৎস্য ! কী অমানবিক ! সমস্ত শরীর শিউরে উঠে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় দশ লক্ষ অষ্ট্রেলিয়ার নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেছিল এবং ঊনচল্লিশ হাজারেরও বেশি মারা যায় । গ্যালারীতে আছে জার্মানী এবং ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে ইউরোপের যুদ্ধ, ভূমধ্য সাগরীয় দেশসমূহ এবং আফ্রিকা, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিভিন্ন প্রদর্শনী । এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে জাপানী সৈন্যদের ডারউইন এবং সিডনী পোতাশ্রয়ের হামলা প্রতিহত করতে হয়েছিল, তারও ছবি এবং ছোট-বড় বিভিন্ন সামগ্রী রয়েছে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গ্যালারী থেকে বেরিয়ে এসে টানা বারান্দা পেরোলেই শেষ মাথায় মূল ভবন থেকে বেরোনোর দরজা । অবশ্য তার আগে রয়েছে স্যুভেনীর বা গিফট্ শপ । অন্যান্য স্যুভেনীর শপের মতো টি-শার্ট, টুপি, ডিভিডি ও সিডি, কফি মগ, চাবির রিং, যুদ্ধ বিষয়ক ম্যাগাজিন এবং বইপত্র সহ অনেক গিফট আইটেম পাওয়া যায় । বিদেশি পর্যটকেরা, বিশেষ করে চায়নীজ এবং জাপানীজ, স্বদেশে ফিরে যাও্য়ার আগে ব্যাগ ভর্তি এসব স্যুভেনীর কিনে নিয়ে যায় ।
প্রতিবার স্যুভেনীর শপ থেকে বেরিয়ে সোজা বাইরে এসে দাঁড়ালে কেন জানি আমার একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে । তখন আমি আপন মনে হাসি । ঘটনাটি ছিল এরকম: একবার এক অতিথি মেমোরিয়ালের ভেতর থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত আকাশের নিচে এসে সোজা হনহন করতে হাঁটতে থাকে গাড়ির দিকে । তখন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং ছিল না । বাম দিকে খোলা জায়গায় গাছের নিচে গাড়ি পার্ক করতে হতো । তার হাঁটার ধরন দেখে আমি রীতিমতো থ’ বনে গেছি । কয়েক সেকেন্ড স্নাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকি । হঠাৎ প্রায় চিৎকার করে উঠি, ‘কোথায় যাচ্ছেন ?’ আমার কন্ঠস্বর শুনে তিনি থামলেন এবং পেছন ফিরে তাকালেন । আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘আমি না হয় এই শহরে বাস করি এবং আমার পুনরায় আসার এন্তার সুযোগ আছে । কিন্তু আপনি চলে গেলে আবার এদেশে আসবেন কি না, তার কোন নিশ্চয়তা নেই । কথায় আছে, অপরচুনিটি নেভার কামস্ টোয়াইস, অর্থাৎ সুযোগ কখনই দ্বিতীয়বার আসে না । তাই আরো পনের মিনিট ব্যয় করে বাকিটুকু দেখে যান । তাহলে মেমোরায়াল দেখাটা পূর্ণতা পাবে ।’ অতিথি আমার কথায় উচ্চবাচ্য না করে বিরস বদনে আমাকে অনুসরণ করে ।
আমরা মেমোরিয়ালের পশ্চিম পাশে স্কাল্পচ্যার গার্ডেনে যাই । সেখানে আছে বিভিন্ন ধরনের স্মৃতিস্তম্ভ, ট্যাঙ্ক এবং কামান । স্কাল্পচ্যার গার্ডেনে ঢোকার সময় প্রথমেই চোখে পড়ে সিম্পসন এবং তার গাধার স্মৃতিস্তম্ভ । এই স্মৃতিস্তম্ভ ১৯৯৯ সালে উদ্বোধন করা হয় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জন সিম্পসন (১৮৯২-১৯১৫) ছিলেন তুরস্কের গ্যালিপলি রণাঙ্গণে । তার প্রধান কাজ ছিল যুদ্ধের ময়দানে আহত সৈনিকদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া এবং পরবর্তীতে তাদের নিকটস্থ ঘাটিতে নিয়ে যাওয়া । আহত সৈনিকদের বহন করার জন্য তিনি তার গাধা ব্যবহার করতেন । প্রচন্ড যুদ্ধের মাঝে তিনি গাধা নিয়ে সাড়ে তিন সপ্তাহ সেবা করেছেন । কেননা শত্রুপক্ষের বোমার আঘাতে তিনি নিহত হন । সেই থেকে সিম্পসন ও তার গাধা অ্যানজাক লিজেন্ড হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং অষ্ট্রেলিয়ার সাহসী যোদ্ধার মর্যাদা পেয়েছে ।
যাহোক, অতিথির তাড়া দেখে অন্য দিকে যাওয়া হয়নি । শুধু সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুটা দূরের একটা পাইন গাছ দেখিয়ে বললাম, ‘অই যে দূরে পাইন গাছ দেখা যাচ্ছে, ওর একটা সুন্দর ইতিহাস আছে । গাছটির নাম ‘লোন পাইন ট্রি’ [Lone Pine Tree] । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গণ গ্যালিপলির পাইনের মোচা থেকে চারা বানিয়ে এই গাছটি লাগানো হয়েছে । কোন এক সৈনিক পাইনের মোচাটি স্যুভেনির হিসাবে তার মাকে পাঠিয়েছিল । পরবর্তীতে যেসব অষ্ট্রেলিয়ার সৈন্য গ্যালিপলির লোন পাইন এলাকায় পাঁচ দিনের (৬-১০ আগষ্ট, ১৯১৫) তুমুল যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, তাদের স্মরণে গাছটি লাগানো হয় ।
ফেরার পথে পেছনে মেমোরিয়াল রেখে দক্ষিণমুখী দাঁড়ালে দেখা যায় প্রশস্থ ‘অ্যানজাক প্যারেড বা ব্যুলেভার্ড’ । অ্যানজাক সৈনিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নামকরণ করা হয় । মেমোরিয়ালের পাদদেশ থেকে শুরু করে বার্লি গ্রিফীন লেকের উত্তর পাড় পর্যন্ত বিস্তৃত । লাল সুড়কি বিছানো অ্যানজাক প্যারেডের দুপাশে যাওয়া-আসার জন্য আলাদা সড়ক রয়েছে এবং সড়কের পাশে বিভিন্ন যুদ্ধে অষ্ট্রেলিয়ান সৈন্যদের জীবন দানের স্মারক চিহ্ন হিসাবে গাছ-গাছালীর ফাঁকে অসংখ্য স্মৃতিস্তম্ভ বা ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে আছে ।
এ কথা সত্যি যে, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নিহত সৈনিকদের মহান আত্মত্যাগের স্মৃতি উত্তরসূরীদের কাছে সজীব রাখার জন্য নির্মাণ করা হয় জাদুঘর কিংবা স্মৃতিসৌধ । যাহোক, আগেই বলেছি আমি অসংখ্য বার অষ্ট্রেলিয়ান ওয়ার মেমোরিয়ালে গিয়েছি এবং বিভিন্ন সময়ে দেখেছি প্রচুর, জেনেছি বিস্তর । তবে যতবারই সেখানে গিয়েছি, ততবারই ফিরে আসার সময় আমার মনে হয়েছে পেছনে কোথাও যেন শ্রদ্ধা রয়ে গেল ।
Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2018/%e0%a6%85%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%93%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a6%bf/
Copyright ©2024 PriyoAustralia.com.au unless otherwise noted.