অবিন্যাস্ত

by Naina Shahrin Chowdhury | August 29, 2018 5:36 pm

এক ভোর রাতে নিজের অস্তিত্বের ব্যবচ্ছেদ করতে করতে শেষ পর্যন্ত যেটায় উপনীত হলাম, তা হল, এই হিসেবি ঘেরাটোপের, আর হিপোক্রেসিতে ভরা দাম্পত্য আমৃত্যু ছেঁচরে টেনে নেওয়া আর সম্ভব না। মাসুদ তখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল। ওর নাক ডাকের শব্দ ছাপিয়ে যাচ্ছিল বাইরে পাখীর ডাক আর অন্যান্য শব্দকে। মাসুদ নির্বোধ। তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে যদি বলা হয়, তার সাথে আর থাকব না, সে আরেক কাত হয়ে শুয়ে পড়বে। আমি শান্ত ভাবে বারান্দায় যাই। গ্রিলে হাত রেখে কিছুক্ষন দাঁরাই, তারপর নিজেকে কিছুটা বোঝানোর চেষ্টা করি। এই চেষ্টাটা গত ২৫ বছর আমি করেছি।চেষ্টাটা এই মুহূর্তে অর্থহীন মনে হচ্ছে, তাও মাসুদ না ওঠা পর্যন্ত এই জিনিস চলুক। আমি নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করি, বিয়ের এতগুলো বছর বাদে কেন মাসুদকে ত্যাগ করতে চাও।  আমি মনে মনে উত্তর দেই, মাসুদ বিরক্তিকর, ভালবাসাহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন।

-সেটা আগে বোঝনি।

-বুঝলেও তাকে সুযোগ দিয়েছি। হয়ত একদিন ঠিক হবে।

– তোমার সন্তান আছে, এবং তারা বড় হয়েছে…

– বড় হয়েছে বলেই নির্ভরশীলতা কমেছে। আর তারা আমার সিদ্ধান্ত বোঝার মত সক্ষম।

– তাদের বিয়ের সময় সমস্যা হবে।

– আমার মনে হয় এমন কোন পরিবারে তাদের বিয়ে করা ঠিক হবে না যেখানে তাদের মায়ের সিদ্ধান্তকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়।

– মাসুদ এর রিএকশন কি হবে ভেবেছ?

– সে রাগারাগি করবে, এর বেশি সে কিছু করতে পারবে না।

– আর এখান থেকে বেরিয়ে তোমার অবলম্বন কি হবে।

– আমার অবলম্বন হবে স্বাধীনতা, কত বছর পরাধীন ছিলাম ভাবতে পার। কোথাও যেতে হলে, মাসুদের অনুমতি নিতে হতো। ছেলেমেয়েদের কথা ভাবতে হতো, একটা খাবার, একটা পোশাক কিনতে ইচ্ছা করলেও কিনতাম না। সখ গুলো সব একটা বাক্সে ভরে ধুলোয় ফেলে রেখেছিলাম।

– হেঁয়ালি ছাড়, টাকা কোথায় পাবে, বাপের বাড়িতে জায়গা জুটবে ভাবছ?

– টাকা পয়সা উপার্জনের কোন উপায় বের করে নেব, আগে তো খোলা পৃথিবীতে বেরোই। এসব ভেবে নিজেকে বঞ্চিত করেছি ২৫ বছর। আর নয়।

আমি বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলাম। একটা ব্যাগে কিছু কাপড় ভরতে ভরতে গত রাতের কথা মনে পড়ল। সাদাকাত সাহেবের বাসায় মাসুদ সন্ধ্যার পর আমাকে নিয়ে গেল। সাদাকাত সাহেব কে, মাসুদের ব্যবসায় তার অবদান কি এসব কিছুই মাসুদ বলেনি আর আমিও জিজ্ঞেস করিনি, অভ্যাসবশত। কিন্তু, না চিনেও তাদের সাথে ঘণ্টা তিনেক হাহা হিহি করতে হয়েছে। ওয়াইন না খেয়েও গ্লাস ধরে ঘুরতে হয়েছে। অসভ্য সব জোক হজম করতে হয়েছে। আর তারপর, ভদ্রতা করে দু একটা কথা সাদাকাত সাহেবের সাথে হয়েছিল মেকি হাসিতে। মাসুদ লিফটে উঠেই চর কশাল। গালে দাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে, ছেলে মেয়েদের চোখ বাঁচিয়ে বাথ্রুমে ঢুকে মুখ ধুতে ধুতে গত পঁচিশবছরের অগুনিত ঘটনা চোখে ভাসতে লাগল। ঐ তো, অবিন্তার ১৫ তম জন্মদিনে, ৪ টা ছেলে এসেছিল মেয়ে বন্ধুদের সাথে, তাদের আপ্যায়ন কেন করা হল, অথবা, রোদ্দুরের থার্ড সেমিস্টারের রেজাল্ট খারাপের পেছনে আমার হাত আছে, কিংবা, মার্কেটে সামাদের সাথে হঠাৎ দেখা আমার ছিনালিপনার উছিলা, এসব কত রকম অভিযোগ, নোংরা কথা, আক্রমন মাসুদ আমাকে করেছে। বিয়ের পর, ভালবাসার নামে ১০ মিনিটের একপাক্ষিক জৈবিক চাহিদা পূরণ প্রেম হতে পারে না। অথচ, এ জীবনে তো এত এত টাকা চাইনি। ভালবাসা চেয়েছিলাম। নিজের ইচ্ছায়, নিজের পছন্দে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কার জন্য কেন এত অ্যাডজাস্টমেন্ট?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেন টানি ব্যাগের। গলায় ওড়না ঝুলিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ি। আজ থেকে আমি মুক্ত। এই চিন্তাটাই আমাকে সকল দায় সকল জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত করেছে। আমি গেট পেরিয়ে রিকশায় উঠি। কোন অচেনা গন্তব্যের ট্রেনে উঠে বাকিটা ভাবব। সকালটা কি সুন্দর!

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2018/%e0%a6%85%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4/