হ-য-ব-র-ল

by Masud Hossain Mithun | April 11, 2018 12:26 am

বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা। তার সাথে হাত মিলিয়েছে দমকা বাতাসসহ অঝর বৃষ্টি সেই ভোরবেলা থেকে। উইকএন্ড এর জন্য বরাদ্দ সকল কাজই ভেস্তে গেল। জানালায় দাঁড়িয়ে, রাজীব তার ব্যাকইয়ার্ডে বৃষ্টি পড়া দেখতে লাগলো। ঠিক পছন্দ হলো না তার, বৃষ্টির এই রূপ। মনের মাঝে ভেসে উঠলো তার দেশের অবারিত সবুজ প্রান্তরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি যেন পর্দা হয়ে ঢেকে দিয়েছে স্বল্প দূরের চিত্রকে। বৃষ্টিস্নাত গাছের সবুজ পাতা, নতুন করে প্রাণ পাওয়া সবুজ ঘাস আর ভেজা মাটির গন্ধ একে একে জবর দখল করলো তার মনকে। বেশ অনেকটাই নস্টালজিক হয়ে ভাবতে লাগলো কতদিন এমন বৃষ্টিভেজা দিনে বন্ধুদের নিয়ে চাসহ তুমুল আড্ডা, তাস খেলা, খিচুরি, মাংস ভাবনা আর এগুতে পারলো না। নস্টালজিকতা পুরোই গ্রাস করলো রাজিবকে। ভাবতে যতটুকু সময় নিল, সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিল না ততটুকু। চট করে স্ত্রী বন্যার সাথে আলাপ করে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত হলো সে। একে একে ফোন করলো তুষার, শুভ, আসিক, হাসান ও সুনীলকে। সপরিবারে সবাই আসবে বিকেল নাগাদ এবং আড্ডা চলবে গভীর রাত অবধি। অতি কাছের বন্ধু সজলকে ফোন করতে গিয়েও হাত আড়ষ্ট হলো রাজীবের কোন এক অসহনীয় ও বিব্রতকর কারণে। চাঙ্গা হয়ে ওঠা মনটায় বিষন্নতার প্রবেশ। ফোন আর করা হলো না সজলকে।

প্রতীকী ছবি[1]

প্রতীকী ছবি

এদিকে বন্যা খাবারের মেনু ঠিক করেছে, তেলা খিচুরি, গরুর মাংস, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা তার সাথে জলপাই আর আমের আচার। মেনু দেখে গরুর মাংসের বদলে খাসির মাংসের পরামর্শ দিল একান্তই সুশীলের কথা ভেবে। আর সন্ধ্যাবেলার আড্ডার মশলা হিসেবে যোগ করলো চা এবং ঝাল মুড়ির। সকল আয়োজন শেষ। বন্ধুদের আসতে এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি। এর মধ্যে অন্তত একটা জরুরি কাজ সে ঘরে বসেই করে ফেলতে পারে। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে আর শত বাধা উপেক্ষা করে দু’একজন সুহৃদ বন্ধু আর কমিউনিটি ফ্রেন্ডস মিলে, বিদেশে নিজেদের সংস্কৃতি আর মাতৃভাষা সমুন্নত রাখতে সিডনীতে প্রতিষ্ঠা করেছে একটা বাংলা স্কুল। অকস্মাৎই চোখের সামনে ভেসে উঠে সকল শুভাকাংখি, সহযোগী এবং নিবেদিতপ্রাণ মানুষগুলোর চেহারা আর তার সঙ্গে সকল বৈপরিত্য। ভাষা সৈনিক (সালাম) এর ছেলে হয়ে রাজীব ভাবতেই পারে না, তার সন্তানেরা বাংলা বলবে না, বাংলা জানবে না! জীবনের ভিন্ন ভিন্ন তাগিদে আমরা প্রবাসি হয়েছি ঠিকই কিন্তু পরবর্তি প্রজন্মের কাছে আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি পৌছে দেবার কোন দায়িত্বই কি আমাদের নেই।

দরজায় কলিংবেলের শব্দ। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে পেবেশ করলো তুষার, তার স্ত্রী কণা ও তাদের বাচ্চারা। তুষারের মেয়ে তৃণা সালাম দিয়ে জানতে চাইলো কেমন আছো চাচ্চু। মনটা খুশিতে কানায় কানায় ভোরে উঠলো রাজীবের। এতটুকুন মেয়ের কাছ থেকে এইরকম বাক্য বিনিময়ের জন্যই তো তাদের প্রচেষ্টা দীর্ঘ দিনের। খুব ভালো লাগলো এই ভেবে যে একজন খেটে খাওয়া মানুষের সন্তান হয়েও তুষার ও তার স্ত্রী কণা বাংলাকে ধারণ করে অন্তরে। এরপরই উপস্থিত হল শুভ এবং দিনা দম্পতি ও তাদের পরিবার। হাই আংকেল, হোয়াটস দ্যা অকেশন টূডে, শুভর মেয়ে তুলির প্রশ্ন। আমরা মানে বড়দের আড্ডা আর তোমাদের হ্যাং আউট। তা তুমি কেমন আছো মামনি। রাজীব মনে মনে বলল, হায়রে ভাষা সৈনিক রফিক! এই কি ছিল তোমার কাংখিত লক্ষ্য, তোমার উত্তরসূরিদের কাছ থেকে?

টিং, টিং, কলিংবেল। উপস্থিত সুনীল, তমা ও তাদের ছেলেমেয়েরা। সুনীলের কন্যা নমস্কার জানিয়ে আমায় জানালো আগামীকাল সে বাংলা স্কুলে ক্লাশ শেষে আমাকে একটি গান শোনাতে চায়। যেটা সে নতুন শিখেছে বাংলা স্কুলের আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠানে করবে বলে। এতটুকুন বাচ্চার কাছেও রাজীবের মনটা কৃতজ্ঞতায় ভোরে উঠলো। মাগো তুমি কি গান করবে রাজীবের প্রশ্ন? আমি তোমাদের বাবাদের জন্য গান করবো, সালাম সালাম হাজার সালাম। কি বলবে, কিছুই বলার ভাষা খুজে পেল না রাজীব!

দরজায় উপস্থিত সপরিবারে হাসা। হাসানের স্ত্রী অর্থাৎ শিল্পী ভাবি বোরখার আড়ালে থেকে আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে ভিতরে চলে গেল। বেশ ভুষা ও তাদের আদব কায়দায় হাসানের পরিবারের বেশ কিছুটা পরিবর্তন নজরে এলো রাজীবের। মাত্র দুই মাস আগেও যখন ওদের উভয় পরিবারের দেখা হয়েছিল তখনও বাচ্চারা পাঞ্জাবি আর হেজাব পরিহিত ছিল না। সবশেষে উপস্থিত হল আসিফ, জয়া আর তাদের ছেলেমেয়েরা। জয়ার বাবা ৭১ এর একজন বীর মুক্তিসেনা। দেশ স্বাধীনের পর জন্ম বিধায় বীর বাবার মেয়ের নাম রাখা হয়েছিল জয়া। যদিও প্রবাসি হবার পর থেকেই বাবার চেতনা থেকে বেড়িয়ে এসে জয়া সপরিবারে পোশাকআশাক, খাদ্যাভাস ও দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় মোটামুটি সম্পূর্ণভাবেই বৈদেশিক প্রভাবে প্রভাবিত।

প্রতীকী ছবি[2]

প্রতীকী ছবি

ফ্যামিলি রুমের মাটিতে আড্ডার ব্যাবস্থা করেছে বন্যা। আগে থেকেই রুম হিটার অন করে রেখে রুমের তাপমাত্রা আড্ডার জন্য উপযুক্ত করা হয়েছে। আর সব বাচ্চা-কাচ্চারা হৈ-হুল্লোড় করবে লাউঞ্জে। আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। ট্রেতে করে চা আর ঝাল মুড়ি হাতে উপস্থিত বন্যা। এক সাথে সকলের উল্লসিত চিৎকার, বন্যা জিন্দাবাদ। আড্ডা তেমনি চরমে পৌছেছে যেমনটি হতো অনেক বছর আগে বাংলাদেশে এই বন্ধুগুলোই যখন জড়ো হত বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন জনের বাসায়। এই আনন্দময় পরিবেশেও রাজীবের বারবারই মনে হতে লাগলো এক বন্ধুর কথা। যে কিনা দেশে থাকাকালিন অনেক আড্ডায় তাদের সাথে একই উচ্ছ্বাসে হেসেছে, অনেক কাজের সময় কাঁধে কাধ রেখে অনেক পথ করেছে পার।

প্রতীকী ছবি[3]

প্রতীকী ছবি

সিডনীতে থাকা সত্ত্বেও সজলকে কেন আজ তাদের আড্ডায় ডাকতে পারলো না? সজলের বাবা ৭১ সালে পাক সেনাদের সহচর ছিল বলে? যদিও এই রুঢ় তথ্যটি তারা জেনেছে স্বাধীনতার বহু বছর পর। তথ্যটি জানবার আগে পর্যন্ত আমরা সাতজন ছিলাম একে অপরের প্রিয় বন্ধু, যাকে বিশ্বাস করা যেত নিজের মত, ভরসা করা যেত নিজের থেকেও বেশি। পরিস্থিতি হয়তো এতটা খারাপ হত না যদিনা আমরা জানতে পারতাম যে সজলের বাবার সহায়তায় পাক বাহিনী হামলা করে সুনীলদের বাসায় এবং নিহত হন সুনিলের বাবা। এরপর আর কোনদিন সুনিল আর সজলকে সামনাসামনি করা সম্ভব হয় নি এবং সজল ও আর সেভাবে আমাদের সান্নিধ্যে স্বচ্ছন্দবোধ করেনি। অগ্যতা আমাদের বন্ধুদের আড্ডার তালিকা থেকে সজলের নামটা বাদ পড়ে যায়।

কি রে, কি ভাবছিস? শুভর প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পায় রাজীব।
শুভ, তুই কি এখনও তোর বাংলা স্কুল নিয়ে ভাবছিস?
রাজীব, তোদের সহায়তা পেলেতো আর এতোটা ভাবতে হতো না।
কণা, কেন রাজীব ভাই, আমার বাচ্চারাতো নিয়মিত যাচ্ছে বাংলা স্কুলে।
রাজীব, তোমার বাচ্চারা নাহয় যাচ্ছে। আর সবাই যদি এগিয়ে না আসে তবে এটাকে ধরে রাখবো কিভাবে? আর বাংলা ভাষাটাকেই বা মেইন স্ট্রিম স্কুলের সেকেন্ডারি ল্যাংগুয়েজ লিস্টে ঢোকাবো কিভাবে? পৃথিবির বুকে একমাত্র ভাষা যার জন্য মানুষ আন্দোলন করেছে, যে দেশের নাম তার ভাষার নাম দিয়ে, সেই ভাষা এই লিস্টে থাকবে না, এটা ভাবা যায়?
দীনা, রাজীব ভাই বুঝলাম, কিন্তু এই বাংলা ভাষা শিখে ওদের কি লাভ হবে? বাংলা ওদের অনেক কঠিন লাগে। ওরা বাংলা বলতে ও শিখতে চায় না। ওরা বাসাতেও ইংরেজিতেই কথা বলে।

জয়া, ঠিকই বলেছো দীনা। দেশই যখন ছেড়েছি তখন আর ভাষাকে ধরে রেখে লাভ কি? বাবাতো দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। কি দিয়েছে আমাদেরকে ঐ দেশ?

হাসান, বাচ্চাদের প্রত্যেকে হয়তো অসি টেস্ট নাহয় সিলেক্টিভ টেস্ট নিয়ে অনেক ব্যস্ত। তাছাড়া খুব কষ্টকরে যতটুকু সময় বের করেছি, সে সময়টাতে আরবী শিখছে। মুসলমান হিসেবে আরবী শিক্ষাটাতো অবশ্যই জরুরি। এতকিছুর পর বাংলা শেখার জন্য সময় বের করা ওদের জন্য সম্ভবপর নয়। এতোটা চাপ আমরা ওদের দিতে চাই না।

প্রতীকী ছবি[4]

প্রতীকী ছবি

তমা, হাসান ভাই, সবই বুঝলাম। একবার ভাবুনতো সুনীল এর দাদুমশাই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা। তিনি ছিলেন আইনজীবি, যিনি একসময় তৎকালীন পাকিস্তানে, কুমিল্লা বাংগোরা হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তিনি কেন প্রথম ২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান এসেম্বলিতে বাংলাকে রাষ্ট্রাভাষা করার দাবী তুলেছিলেন? কেন আমাদের ভাষা আন্দোলন দরকার হল? উর্দু রাষ্ট্র ভাষা থাকলে কি ক্ষতি হত?

মেঝেতে সবার সামনে রাখা রাজীবের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। স্ক্রীনে ভেসে উঠলো সজলের নাম। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকে। বড় বিব্রতকর অবস্থায় ফোন রিসিভ করে রাজীব।ওপার থেকে সজলের কন্ঠ ভেসে আসে। আজ সারাদিন বৃষ্টি আর পরিবেশটা এমন যে কিছুটা নস্টালজিক হয়ে পড়েছি। সেই আড্ডা, সেই তাস খেলা আর সেই সব বন্ধু সবার কথা খুব মনেপড়ছে। অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে সংযত করতে কিন্তু পারলাম না। তাই ভাবলাম তোকে একবার ফোন দেই। চোখের বাধ ভেঙ্গে যায় রাজীবের, বুকের পাঁজরে মমি করে রাখা স্মৃতিগুলো বিবেকের কারাগার আছড়ে পড়তে থাকে। আড্ডা আর জমলো না। রাতের খাবার শেষে সবার বিদায়ের পর রাজীব বিছানায় শুয়ে সারাদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো, কথোপকথনগুলো, অতীত স্মৃতি সবকিছু মনে করতে চায়। মনেমনে বলল হ-য-ব-র-ল।

গায়ে কম্বল টেনে নিয়ে বেড সাইড ল্যাম্পটা অফ করে দিল রাজীব।

মাসুদ হোসেন মিথুন

Endnotes:
  1. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/04/1-5.jpg
  2. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/04/30595024_715485558841266_3074685096280719360_n.jpg
  3. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/04/30624185_716063982116757_5820511822381318144_n.jpg
  4. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/04/1.png

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2018/%e0%a6%b9-%e0%a6%af-%e0%a6%ac-%e0%a6%b0-%e0%a6%b2/