ভালো থাক সবুজ পাসপোর্টেরা

by Sharifa TulTuly | April 7, 2018 11:51 pm

বাড়ী থেকে আসার সময় শাশুড়ি বরই এর” টক মিষ্টি আচার” দিয়েছিলেন। পার্থের বিমান বন্দরের ইমীগ্রেসনের কড়াকড়ি, তাই বলেছিলাম দেওয়ার দরকার নাই, কিন্তু স্নেহ ভালোবাসার পরশযুক্ত আচার আমাদের সত্যি আনতে হল। প্লেনের ফর্মে আমরা ডিকলিয়ার করেছিলাম যে কুকড ফুড (রান্না খাবার ) নিচ্ছি। অনেকের কাছে শুনেছি” বেবী ফুড (শিশুর খাদ্য )” বললে ওরা আর বাধা দেয় না নিতে। তো, আমরা পার্থ বিমান বন্দর ইমীগ্রেসনে পৌঁছছালাম। এক ইমীগ্রেনট মহিলা পুলিশ বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন” এটা কী?” বললাম,” বেবী ফুড” । তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন” হোয়াটস টাইপ অফ বেবী ফুড?” বললাম,” এটা অনেকটা আচারের মতো।” তিনি ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি আর রাগ নিয়ে ললেন,” বেবী ফুড কী করে প্রীকেলের মতো হয় ! !? ? বেবী প্রীকেল খায়? ! তুমি এটা নিতে পারবে না, আমি সরি এটা আমাকে বিনে ফেলে দিতে হচ্ছে।” ভাবলাম, আহারে শাশুড়ি বেচারি কতো ভালবাসা নিয়ে আচার বানিয়েছেন আর তা এই ভিনদেশের ডাস্টবিনে পড়বে ! ! বললাম,” তুমি ডাস্টবিনে ফেলে দাও, কিন্তু তার আগে আমি আমার দু হাত ভরে আচার নিতে চাই, আমি বাসায় যেতে যেতে খাবো, এটা খুব মজা, আমাদের দেশের মেয়ে বাচ্চা বুড়ো সবাই শখ করে খায়, তুমি ট্রাই করে দেখতে পারো। জানিনা মহিলা পুলিশের কী হল, বিরক্তিতে ভাজ হওয়া ভ্রূর চামড়া তার প্রশস্ত হল, তিনি বিশ্বাস ভরা চোখে বললেন,” না, থ্যাংকস আমি এটা খেতে চাচ্ছীনা, তুমি প্রীকেলের কনটিনারটা নিয়ে যেতে পারো। এটা ২০১৫ সালের ঘটনা।

এবার মানে ২০১৮ সালে যখন আবার বাড়ী থেকে ফিরছি শাশুড়ি কিছু লাল চাল দিলেন, যাকে বলে দীঘা ধানের চাল, শাশুড়ির মেজ ছেলে শখ করে ফ্যানা ভাত খায়। এবার সুদর্শন এক ইমি গ্রেনট পুলিশ। স্ক্যানে চাল ধরা পড়লো (যদিও ফর্মে ডিকলীয়ার করেছিলাম চালের কথা ) তিনি সব চালকে একটা বড় পলিথিন ব্যাগের উপর ঢাললেন। মেয়ের বাপকে বলছিলাম,” এখন কী এই লোক চালের মধ্যেকার কাঁকড় বাছতে বসবেন ! ! কিন্তু সত্যি সত্যি তিনি কাঁকড় বাছতে বসলেন এবং মিনিট তিনেক পরে চালের মধ্যে একটা ধান আবিষ্কার করলেন আর ধান যেহেতু সীড সেহেতু তা নিয়ে এই দেশে ঢোকা নিষেধ, এই একটা ধান তাদের কৃষির অথবা মাটির কতটা ক্ষতি করতে পারে সে কেবল তারাই জানে।, তাদের সাবধানতা বিরাট পর্যায়ের। বিশাল ভূখণ্ড অথচ সেই তুলনায় লোক এতো কম, তারপরেও দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান প্রশাসনের বিরাট ভাবনা। রান্না করা বরই আচারে অথবা বরইয়ের বীচে নতুন গাছ হবে না, নিশ্চিত করে, ভেবেচিন্তে, প্রশ্ন করে, উত্তর পেয়ে তবে তারা ছেড়ে ছিলেন, আর একটা ধানের জন্য ঘুপুত করে দুই কেজী শখের লাল চাল ডাস্টবিনে অতি বিনয়ের সাথে ফেলে দিলেন।

আর ওদিকে দেখুন আমাদের বাংলাদেশ …প্লেন থেকে নামলেন আর আপনি রাজা। কোন সমস্যা নাই, গা- গতর – শরীর, খাবার কোন কিছুতেই কোন সমস্যা নাই, কোন চেক, ফেক, টেকের ঝামেলা নাই। আপনি হাতি ঘোড়া নিয়েও বিমান বন্দর দিয়ে বের হতে পারবেন, খালী জাস্ট তারা দেখবে আপনার পাসপোর্টটা। যদি ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্ট হয়, তবে তো কথাই নাই ! !

এবার বলি আরেক কাহিনী, দেখতে শুনতে তো আমি বেশী সুবিধার না, আবার ধরেন বেশভূষাও বিদেশী না অথবা পোশাকের মধ্যে কোন আভিজাত্য নাই আমার। তো আমাদের দেশের বিমান বন্দরের ইমিগ্রেনট পুলিশেরা আমাকে মনে করে বোধ করি মিডিলইষ্ট ফেরত শ্রমিক, ঝাড়ি মেরে কথা বলে, বিরক্তি দেখায়। যখন দেখে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসলাম তাদের চোখ মুখের চেহারা পাল্টে যায় মুহূর্তে।, এক মুহূর্তে এক চেহারায় আমি একই সাথে অবহেলা আর গুরুত্ব দেখার সুযোগ পাই। মনে মনে হাসি, বোঝে না অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকার মতো উন্নত দেশে যারা থাকে তারা দেশে আসে শুধু মাত্র অবকাশ যাপনের জন্য। তারা জানে না এসব উন্নত দেশে বসবাসরত প্রবাসীরা দেশকে কিচ্ছু দিতে পারে না, শুধু নেয়। তারা জানে না উন্নত দেশে বসবাসরত উচ্চশিক্ষিত প্রবাসীরা দেশের সম্পদ এনে বিদেশে সম্পদ গড়ে। তারা জানে না মিডিলইষ্টে বাস করা অর্ধশিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত প্রবাসীরাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখে, তারা জানে না সদ্য যুবা অথবা কিশোর ছেলেটা মরুভূমিতে খেটে খেটে দেশ গড়ছে। বাংলাদেশ বিমান বন্দরে এসব কিশোর অথবা সদ্য যুবা দের অনিশ্চিত ভিতু চোখের দৃষ্টির দিকে আমরা কী কখনো মনোযোগ দিয়ে তাকাই? , তাদের পায়ের মোটা বেল্টের স্যান্ডেল, নীল জীন্সের প্যান্ট, সাথে ইন করা শার্ট, কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ আরেক কাঁধে মায়ের বাপের মমতার হাত, আমরা কি দেখি কখনো? ? না, আমরা দেখি না। দেখি না বলেই আমরা ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্ট আর দেশী সবুজ পাসপোর্টের মর্ম বুঝী না, দেখি না বলেই কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ আর চকচক্কা লেদারের ট্রলিব্যাগের পার্থক্য আমরা বুঝি না। আমার আসল চিনি না, শুধু নকল চিনি। আমরা ন্যাচারাল বুঝি না, শুধু চকচক্কা বুঝি। কেননা আমাদের তা বোঝানো হয় না, কেননা আমরা বুঝলেও না বোঝার ভান করি। আমরা শুধু বিভেদ বুঝি, বিভেদে কী স্বাধীনতারা থাকে !?

ভালো থাক সবুজ পাসপোর্টেরা। বুঝতে পারুক তাদের মর্ম আমাদের স্বাধীনদেশ। মর্যাদা পাক, গুরুত্ব পাক, অবহেলা না পাক সবুজ পাসপোর্টের মালিকেরা। ভালো থাক দেশের চক্রজানেরা। ভালো থাক দেশ, ভালো থাক স্বাধীনতা।

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2018/%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%8b-%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%95-%e0%a6%b8%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%9c-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%aa%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a7%87%e0%a6%b0/