রবীন্দ্রনাথ ও কিছু বাংলাদেশী

by Tarik Zaman | November 26, 2017 1:52 am

সবুজ, আমি তোমার বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে লেখার মন্তব্যের ঘরে লিখতে গিয়ে দেখলাম যে অনেক বড় হয়ে যাবে, তাই ভাবলাম তোমার পোস্টকে acknowledge করে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখি।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বলাটা অনেক বড় স্পর্ধা কারণ আমি যোগ্য নই, বরং রবীন্দ্রনাথের দোষ-ত্রূটি অন্বেষণকারী বাংলাদেশীদের নিয়ে একটু বলি। এদের সম্পর্কে বলা একটু সহজ কারণ এদের খুব কাছ থেকে দেখেছি, এখনো দেখছি। পৃথিবীতে এতো আলো থাকতেও এদের ভেতরে সামান্য আলো প্রবেশ করে না বা করতে দেয় না ধর্মের শিয়ালটা। ধর্মের একটা শিয়াল একটু রা’ করলেই অনেকগুলো শিয়াল রা’ করা শুরু করে।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম অপরাধ রবীন্দ্রনাথ মুসলমান নয়। দ্বিতীয় অপরাধ রবীন্দ্রনাথ জন্মগত বাংলাদেশী নয়। এই দোষ অন্বেষণকারীদেরই দেখা যায় নজরুলকে নিয়ে মাতামাতি করতে, কারণ নজরুল মুসলমান, কিন্তু নজরুল যে জন্মগত ভারতীয়- এইটা খুব সন্তর্পে চেপে যায়। অথচ দুইজনই যে ধর্ম নিয়ে বিন্দু মাত্র মাথা না ঘামিয়ে বাঙালিদের মানুষ হিসেবে গড়তে আজীবন চেষ্টা করে গেছেন- এই সহজ সত্যটা স্বীকার করতে চায় না, বুঝতেও চায় না।

রবীন্দ্রনাথ তো কখনো অস্বীকার করেন নাই যে তিনি গগন হরকরার সুর ব্যবহার করেন নাই। ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে, রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশায় চিন্তা করেছিলেন কিনা জানি না, বাংলাদেশ নামটা কিন্তু তার বিভিন্ন লেখাতে পড়েছি। যদি এই কবিতা বা গানটা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত না হতো, তাহলে বোধ হয় এইটা গগন হরকরার সুর না রবীন্দ্রনাথের নিজের- কথা উঠতো না। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার এবং বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে অনেকের লেখা বই পড়ে জানা যায় যে যখন থেকে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চিন্তা করেছিলেন তখন থেকেই সেই রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ কে জাতীয় সংগীত ভেবে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কি পরিমান পড়াশুনা করতেন…. থাকে সে কথা।

১৯৭১ সালেও পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় পঁচিশ ভাগ লোক বাংলাদেশ বিরোধী ছিল, যারা যতটা না বাঙালি তার চাইতে বেশি ছিল মুসলমান। সংবিধানে জিয়াউর রহমানের ‘বিসমিল্লাহ… ‘ সংযোজন আর সংবিধানকে ইতর এরশাদের ‘ইসলামীকরণের’ পর এই সংখ্যা এখন প্রায় চল্লিশ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো এদের সাথে অবশিষ্ট ষাট ভাগের কিছু মানুষ যারা নিজেদের মুখে বাঙালি ছাপ মেরে রাখে, সুবিধামতো মুসলমান হয়ে যায়। তুমি যাদের কথা বলেছো, তারা হলো সেই অংশের যারা সারাদিন পরিচ্ছন্ন সংস্কৃতির ফতোয়া পড়ে থাকে। আসলে এদের ভেতর দুর্গন্ধময়, অনেক অন্ধকার।

স্বাধীনতার সময়েও মনে প্রাণে এরা রবীন্দ্র বিরোধী ছিল। একটা উদাহরণ দেই। বঙ্গবন্ধুর সময়ে মন্ত্রী, পরে এরশাদের সময়ের স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরী ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হোক চায় নাই। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাংলাদেশ সংবিধান রচনার সাথে জড়িত ছিলেন। যখন সরকারি ভাবে ‘আমার সোনার বাংলা’ কে জাতীয় সংগীত হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দেয়া হলো, তখন শামসুল হুদা চৌধুরী অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে (বিপুলা পৃথিবী) বলেছিলো যে আপনারা কোনো মুসলমানের গানকে জাতীয় সংগীত করতে পারলেন না। এই রকম অনেক ছুপা বঙ্গবন্ধুর সরকারে আর সেই পঁচিশ ভাগ মানুষ নয়, মুসলমান ছিল বলেই জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ সংবিধানের সুন্নতি করিয়ে দেশকে একটা সংকর খচ্চরের পর্যায়ে এনেছে বলেই শেখ হাসিনা সেই খচ্চরকেই বয়ে চলেছেন ঘোড়া বানাবেন বলে। কিন্তু তার দলেও এখন মুসলমানের সংখ্যা বাঙালির চাইতে বেশি- তারপরেও শেখ হাসিনা ছেড়ে দিলে তো দেশটা বাগডাসে পরিণত হবে- দুর্গন্ধ ছড়াবে।

আমাদের একজন আঁকিয়ে দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে বিখ্যাত হয়েছেন; তার পরতে পরতে বাঙালিয়ানা, কোনো খাঁদ নেই। অথচ ট্রাম্পের দেশে থাকা তার নাতি-পুতিদের অবস্থা দেখো। সমুদ্র পারের সবচাইতে বড় রাজ্যে কলকাতার বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনুষ্ঠান করলে, সেই আঁকিয়ের এক নাতি বাংলাদেশের বাঙালিদের বলে যে আমাদের খুব শীঘ্রই নজরুলকে নিয়ে অনুষ্ঠান করা উচিত। পুরো ব্যাপারটাই এখানে ধর্মীয় হয়ে গেলো। অথচ কলকাতার বাঙালিরা নজরুলকে নিয়েও অনুষ্ঠান করে- সেটা সে মনেও করলো না। অবশ্য এদের দোষ দিয়ে কি হবে, ফরিদা পারভীনের স্বামী আবু জাফর এবং সোনালী কাবিনের আল মাহমুদের রূপান্তরতো এই সেদিনের কথা। বাঙালি থেকে মুসলমান হয়ে যেতে অনেককেই দেখেছি, অনেকেই হয়তো লাইনে আছে। এরা একদিন সমস্বরে দাবি তুলবে যে জাতীয় সংগীত বদল করতে হবে। একটা অজুহাত তো দেখাতে হবে, হিন্দু কবি বললে খারাপ দেখা যাবে, তাই বলবে এই গানটা যথেষ্ট উদ্দীপনামূলক নয়। অথচ এই জ্ঞান পাপিগুলো একবার পেছনে তাকায় না যে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই গানটা শুনেই বাঙালি পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় ক্যানবেরার মানুকা ক্রিকেট মাঠে আফগানিস্তানের সাথে বাংলাদেশ দলের খেলার সময় যখন আমাদের জাতীয় সংগীত বেজেছিল, অনেক প্রবাসীর সাথে পান্নার আর আমার চোখে পানি চলে এসেছিলো। সিকি শতাব্দীর সুদীর্ঘ্য প্রবাস জীবনের সে এক অনুভূতি, বোঝানো যাবে না।

বুর্জুয়াদের কবি, জমিদার কবি, ব্রিটিশ শাসনের নীরব সমর্থক… আরো কত কিছু বলে রবীন্দ্রনাথকে খাটো করার চেষ্টার ত্রূটি তার সময় সাময়িকীরা কম চেষ্টা করে নাই, কিন্তু তারপর ঘুরে ফিরে রবীন্দ্রনাথের ছায়াতেই বড় হয়েছেন। কবিতা, গল্প-উপন্যাস বা প্রবন্ধের কথা ছেড়ে দেই, শুদ্ধ বাঙালির জীবনে তার সংগীতের কি প্রভাব যে নিতে পেরেছে, সেই জানে সে কি পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পরিবারের ইতিহাস থেকে জানা যায় এই পরিবারে সাহিত্য এবং সংগীতের চর্চ্চা অনেক আগে থেকে যা রবীন্দ্রনাথের হাতে এসে প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। উচ্চাঙ্গ সংগীত এবং সুর সম্পর্কে গভীর জ্ঞান না থাকলে এমন গান লেখা এবং সুর করা যে অসম্ভব তা তার ত্রূটি অন্বেষণকারী বদের দল বুঝতে চায় না। নিজের গানে ত্রি-তালের ব্যবহার তো করেছেনই, নিজের গানের জন্য ভিন্ন ‘রাগ’ ও তৈরী করেছেন। পুরানো গ্রিক গান শুনলে মনে হয় যে রবীন্দ্রনাথের গান শুনছি। হ্যা, সুরটা পরিচিত মনে হচ্ছে , কিন্তু একটু গভীর ভাবে খেয়াল করলে, অর্থাৎ তাল, লয় এবং স্বরলিপি দেখলে বুঝা যায় যে শুনতে একটু একই রকম মনে হলেও এক নয়। রবীন্দ্রনাথ নিয়েছেন, কিন্তু নিজের মতো করে। তার অনেক গান শুনতে একই রকম মনে হয়, কিন্তু স্বরলিপি আর তাল দেখেন, যারা গান গায় তাদের জিজ্ঞাসা করেন। This।s the delicacy of Tagore’s music. এইখানেই রবীন্দ্রনাথ অনন্য।

কিছুদিন আগে ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথের উপর করা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু মন্তব্য এসেছে। সুনীল তো ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ বা তার কাজ নিয়ে কিছু বলেন নাই। সুনীল বলতে চেয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথ বা তার সাহিত্য কর্ম যে ভাবে পৃথিবীতে আলোচিত হওয়া উচিত ছিল সে ভাবে হয় নাই যা মূলত যথার্থ অনুবাদের কারণে। বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথকে যে ভাবে নিজেদের মাঝে অনুধাবন করে বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্যের মাঝে সে ভাবে উপস্থাপিত নয়। এইটা আমাদের কাজ ছিল যা আমরা করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার বিশ্ব সাহিত্য যদি রবীন্দ্রনাথকে সেই ভাবে তুলে না ধরতে পারে সেইটা পুরো সাহিত্য জগতের ব্যর্থতা। রবীন্দ্রনাথ যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে। আমি আপনি টেনে নামাতে পারবো না।

এই যে হটাৎ হটাৎ করে কিছু লোক জাতীয় সংগীত নিয়ে কথা উঠায় বা ক্যাজুয়াল বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কোনো সাহিত্যিকের দেয়া খণ্ডিত সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা….. সব এক সুতায় গাঁথা। এরা ভালো করে জানে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু এবং সত্যিকারের নজরুলকে যদি বাঙালির মন থেকে অর্ধেক সত্যি আর মিথ্যা দিয়ে সরিয়ে দেয়া যায়, তাহলে বাঙালিকে ধীরে ধীরে মুসলমানে পরিণত করে আখেরাতের রাস্তা পরিষ্কার রাখা যায়।

বঙ্কিমের মতো করে বলতে হয়: এইসব জ্ঞানপাপী, সুবিধাবাদী ইতরদের নিয়া এই জাতি কি করিবে?

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2017/%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a5-%e0%a6%93-%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%9b%e0%a7%81-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be/