মেলবোর্নের চিঠি – ১০

by Nadera Sultana Nodi | September 9, 2017 12:13 am

মনে পড়ে আমের বোলের মন আকুল করা মিষ্টি ঘ্রাণ, মনে কি পড়ে টিনের চালে ঝুম বৃষ্টির রিনিঝিনি সুরেলা ধ্বনি! সেই পেঁজা তুলো উড়া নীলে নীল আকাশ ক আর ভাসে চোখে!!!

মনে পড়ে, কাশবনের মায়ায় প্রিয় বন্ধুর হাত ধরে হেঁটে আসা দূরের সেই ধুলো উড়া পথ, ছোট্ট নদীতে পাল তোলা নৌকো! শেষ কবে পেয়েছেন পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ, কবে হেঁটেছিলেন কুয়াশার রহস্য জাল কেটে কেটে শিশির ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে, কবে উন্মাতাল হয়েছেন বসন্তের মাতাল দখিণা হাওয়ায়! গেয়েছিলেন কি ‘শোন গো দখিণা হাওয়া; প্রেম করেছি আমি’!!!

আপনি মনে করতে পারছেন কিনা জানিনা। আমি পারছিনা, একদমই পারছিনা। ষড় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ ছেড়ে আসা পরবাস জীবন পার করছি ৮ বছর হতে চললো। দেশে গিয়েছি দুইবার, তার মাঝে একটা না-যাওয়ার মতোনই। ভুলেই গিয়েছি, ভুলেই গিয়েছি, কবে তোমায় দেখেছিলেম, আঁখির পানে চেয়েছিলেম। ভুলে গিয়েছি এই সব, সব অনুভব!!!

প্রবাসে জীবিকার তাগিদে অনেকেই আমরা কাজ করি সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও। এখানে কেউ কেউ যখন ঘরে ফিরে বন্ধু পরিবার নিয়ে লম্বা আড্ডার প্রস্তুতিতে, কেউ নেয় প্রস্তুতি টানা কাজের শুক্র/শনি/রবিবার। এভাবেই চলে যাচ্ছে জীবন, যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মেই! গত পহেলা সেপ্টেম্বর ভোরে চোখ মেলেই মোবাইলে ফেসবুক ওপেন করেছি, দেখি ফেসবুক জানাচ্ছে ‘অস্ট্রেলিয়াতে আজ বসন্ত দিন শুরু’! এই প্রবাসে পাড়ি দিয়েই জেনেছি এখানে ৪টা সিজন। কিন্তু বাস্তব অনুভবে, বিশেষ করে প্রায় ৬ বছরের বেশি সময় ছিলাম সাউথ অস্ট্রেলিয়া, এডেলেড। ওখানে আছে মুলতঃ শীত ও গ্রীষ্ম। কিংবা বলা যেতে পারে একটু ঠাণ্ডা, বেশী ঠাণ্ডা, একটু গরম, অনেক বেশী গরম, এই তো!!!

এখন আছি মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া, ৯ মাস হতে চললো, এখন পর্যন্ত শুরুতে একটু সামারের দেখা পেলেও এরপর থেকে দেখছি কেবল শীত সময় কাল… সাথে মরার উপর খারার ঘায়ের মত, যখন তখন বৃষ্টি বৃষ্টি, তবে না বাংলাদেশের সেই ঝুম বৃষ্টির দেখা, না তেমন নয় কিন্তু যারা অস্ত্রেলিয়ার বাইরে আছেন তাঁদের জ্ঞ্যাতার্থে জানিয়ে দিলাম।

যাই হোক এবারও অস্ট্রেলিয়ার বসন্ত বার্তা পেলাম ফেসবুকের বদৌলতেই প্রথম, সেই ফেসবুকের নিউজ ফিডে দেখি এখানে থাকা কিছু বাংলাদেশী ভাই-বেরাদর-বোন-বন্ধু পোস্টও দিয়েছে বসন্ত নিয়ে। আমি উৎসবপ্রিয় মানুষ, প্রকৃতির অনেক কিছুই পাগল করে দিতে সময় নেয়না, সেখানে বসন্ত বার্তা, ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত অনুভব নিয়ে, হিমশীতল ঠাণ্ডা তো কি হয়েছে ঝাঁকি দিয়ে উঠলাম সাত সক্কালে। কিন্তু কি করবো, কি করা যায়, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই এই ভাবতে ভাবতেই সব মিলে আর কিছুই হলোনা করা। কাল থেকে টানা ৩ দিন কাজ, নেই তারই প্রস্তুতি। আর তো হলোনা দেখা, জগতে দোঁহে একা, দুজনে দেখা হল, নিজের অজান্তেই উঠে আসে এই সুর.. ইউটিউব প্লে-লিস্টে করে রাখা ‘’ফাগুনেরও মোহনায়’’ নামে কিছু বসন্তের গান নির্বাচন করে রেখেছি, তাই শুনেই আপাত হারাই, ভাসি আর ডুবি বসন্তের এই আগমনী ক্ষণে!

এই পর্যন্ত পড়েই কেউ কেউ কি নস্টালজিক হয়ে উঠছেন? কেউ কি বলছেন, কেন এই স্মৃতি বিলাস! কেউ একজনও কি মন খারাপ করছেন, কারণ মনেই করতে পারছেননা, শেষ কবে ফেলে আসা বাংলাদেশের বসন্ত রুপ খুব কাছ থেকে দেখেছেন! না, আমি আপনাদের একজনেরও মন খারাপ তো করেই দিতে চাইনা বরংচ এই বসন্তে কি করলে আমার মতোন মাতোয়ারা হয়ে ডুবে যেতে পারেন বসন্তের অপরূপ আবহে, ক্ষণিক আনন্দে তাই বলি।

নিজের অভিজ্ঞতাই বলে নেই, পহেলা সেপ্টেম্বর ১৭ দিনশেষে সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে একটু হাঁটতে গেলাম, বাংলাদেশের কামিনী এবং হাস্নাহেনার কাছাকাছি দেখতে একটা ফুলের লম্বা গাছ আছে আমার আঙিনায়, এখনও ফুল ফুটে উঠেনি, তারপরও কিছু কলি থেকেই বোধহয় এতো সুন্দর সুবাস ছড়াচ্ছিল ঝিরি-ঝিরি বাতাসে, ভীষণ মন খারাপের মাঝেও বলে উঠি আহ ”বসন্ত এসেছে”!!! কবিগুরুকেই ধার করে বলি,

মধুর ও বসন্ত এসেছে মধুরও মিলন ঘটাতে,
মধুর মলয়-সমীরে, মধুর মিলন রটাতে,
আমাদের মধুর মিলন ঘটাতে। মধুর বসন্ত এসেছে।
কুহক লেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে,
লিখিছে প্রণয়-কাহিনী বিবিধ বরন- ছটাতে।
মধুর বসন্ত এসেছে।

বসন্ত মানেই নব জীবন, রুপ, প্রকৃতিতে বর্ণীল খেলা, রঙিন প্রজাপতির ডানায় উড়ে চলা সুখ। বাংলার বসন্তের যে রুপ, ভীনদেশেও আছে রুপ, শুধুই ধরা দেয় অন্যভাবে হয়তো। এককাপ চা বা কফি হাতে আপনার ছোট্ট বারান্দায়ই একটু বসেন আজ বিকেল ছুঁয়ে যাওয়া সন্ধ্যায়, চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেন প্রতিবেশীর আঙিনা, কত রঙের ফুল ও কুঁড়ি। একটু হেঁটে আসুন ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া, প্রকৃতি আপনাকে কিছু রঙ দেবেই, সেই রঙের কোনটা মেখে যে আপনি রঙিন হয়ে উঠবেন নিজেও জানেননা হয়তো!

সঙ্গী, বন্ধু বা পরিবার পরিজন নিয়ে একদিন আরো একটু দূরে যান, সবুজের খোঁজে। দেখেন এখানেও প্রকৃতি কত রুপে সেজে বসে আছে আপনাকেই অভিবাদন জানাতে। কোন একটা সুন্দর নিবিড় সবুজে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে বলেন, আহ সুন্দর, স্রষ্টার এই সুন্দর আমি চোখ মেলে দেখছি, উপভোগ করছি ‘’সত্যিই জীবন সুন্দর’’!!!

এটা ঠিক আমাদের যাপিত জীবনের আছে নানান রকম দুশ্চিন্তা। দেশে থাকা মা-বাবা বা খুব কাছের কোন পরিজন ভালো নেই, আছে এখানেও কাজের চাপ বা অনেক রকম অনাকাঙ্ক্ষিত প্যারা। তারপরও দিনশেষে নিজেকে শারীরিক ভাবে সুস্থতার পাশাপাশি মানসিকভাবে সুস্থ রাখাটা খুব জরুরী। মানসিক সুস্থতার জন্যে খুব কাছের প্রিয় কিছু মানুষ এবং সুন্দর প্রকৃতি এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে!!!

আজই সময় করে আপনার বসন্ত উদযাপন করে ফেলুন, আর হে বসন্তের বর্ণীল প্রকৃতির যে রুপ আপনার চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে আসবেন তার সবটুকু চাইলেও আপনি আপনার দূরে থাকা প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করতে পারবেননা। তবে যেটা পারেন, আপনার দেখা কিছু সুন্দর অন্তত হাতে থাকা ক্যামেরায় তুলে নিয়ে আসা। এরপর সময় করে আপনার ফেসবুক দুনিয়া বা অন্য যেকোন ভাবে ছড়িয়ে দেন শেয়ারের আনন্দ কাছের কিন্তু দূরে আছেন এমন প্রিয়জনের মাঝে, দেখেন আনন্দ কত বেড়ে যায়!!!

ছবি শেয়ার অনেকের পছন্দ না, আপনি হয়তো আপনমনে নিজের ভুবনেই ডুবে থাকতে চান, আপনার জন্যে এই বসন্তে কিছু গানের কথা বলি, সময় করে শুনে দেখুন মন ভালো হয়ে নিজের অজান্তেই কোন না কোনটি গুণগুণ করে গেয়ে উঠবেনই।
অন্তত যে দশটি গান শুনতে পারেন ১। দুজনে দেখা হলো ২। মধুর বসন্ত এসেছে ৩। শোন গো দখিণা হাওয়া ৪। আহা আজি এ বসন্তে ৫। বসন্ত এসে গেছে ৬। দখিণা বাতাস লাগে প্রাণে ৭। ফুল ফাগুনের এলো মরশুম ৮। ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে ৯। বসন্ত বাতাসে সইগো ১০। মনে কর আমি নেই বসন্ত এসে গেছে !!!

এই সব গানই পাবেন ইউটিউবে, শুভ হোক তব বসন্ত!!! বসন্তের বর্ণীল শুভেচ্ছা যারা পড়লেন আজকের ‘’আমার এই এলোমেলো অস্ত্রেলিয়ার বসন্ত অনুভব’’। বসন্তের ছোঁয়ায় থাকুক চিরসুন্দর আপনার ভুবন; দক্ষিনা বাতাস লাগুক তব প্রাণে,

নাদেরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2017/%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a6%ac%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%9a%e0%a6%bf%e0%a6%a0%e0%a6%bf-%e0%a7%a7%e0%a7%a6/