বিদায় বাংলাদেশ, ভালো থেকো বাংলাদেশ!

by Md Yaqub Ali | December 19, 2017 11:17 pm

সমাজের নিচুতলার মানুষ হলে, গায়ের রং মলিন হলে, মুখের ভাষায় আঞ্চলিকতার টান থাকলে, বাবার উচ্চ পেশা বা চাকুরী (আমি বলি উচু দরের চোর) না থাকলে এই সমাজে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা কত কঠিন সেটা আমি আমার চলার পথের প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করেছি। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা আমাকে বারেবারেই মনে করিয়ে দিত যে তুমি আমাদের ভদ্র সমাজের অধিভুক্ত নও, তাই যতই তুমি কাকের পুচ্ছে ময়ূরের পালক লাগিয়ে নিজেকে ময়ূর প্রমাণ করার চেষ্টা কর না কেন, তুমি সেই কাকই থাকছো। মাঝখান থেকে তুমি আমাদের কিছু সময়ের বিনোদোনের খোরাক হতে পারো কিন্তু কখনই তুমি আমাদের একজন হতে পারবে না। আমি সেই চেষ্টা করিও নাই কখনও, আমি বরং সবসময়ই উল্টোটাই করতাম। আমি যে গেঁয়ো চাষা ভূত সেই ধারণাটা যেন তাদের মনে পাকাপোক্ত হয় এবং আলাপ শেষে একটা প্রশান্তির ঢেকুর তুলে বলতে পারে আগেই বলেছিলাম না এদের সাথে আলাপ করতে যেয়ো না, এদের ভাষার ঠিক নেই; সেই চেষ্টাটাই সবসময়ই করেছি। তাই কখনও কেউ আমার পূর্বপুরুষের পেশার হদিস করলে আমি একেবারে ভাবলেশহীনভাবে তাকে কঠিন স্বরে আসল পেশাটার কথাই বলতাম। এরপর প্রশ্নকর্তার চোখের চাহনি হত দেখার মত, বেচারা এমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেতো দেখে আমি মনে মনে পুলকিতই হতাম।

আর সমস্ত নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করা ছিল আমার প্রিয় শখ। আমাকে কোন কিছু করার জন্য চাপাচাপি করলে আমি কখনই সেটা করতাম না, তাই আব্বা-মা আমাকে কখনই কোন কিছু করার জন্য চাপাচাপি করতো না। কারণ জানতো সেটা যদি আমি করতে চাই, তাহলে এমনিতেই করবো না হলে কখনই করবো না আর। তাই প্রাথমিকে আমার ফলাফল কখনই নিয়মিতভাবে ভালো হত না, এক ক্লাসে অনেক নম্বরের ব্যবধানে প্রথম হলাম তো পরের ক্লাসে আমার রোল নম্বর আর নোটিস বোর্ডের কোথাও খুজে পাওয়া গেল না। কারণ একবার প্রথম হওয়ার পর আমার মনেহত আরে ধুর ইচ্ছা করলেই তো প্রথম হওয়া যায় এটা নিয়ে মাতামাতি করার এত কি আছে? আর যারা মোটামুটি নিয়মিত প্রথম হত তাদের আচার আচরণও আমাকে কিছুটা মর্মাহত করতো, তাই প্রথম হওয়ার চিন্তাটাকে আর মোটেও মনে স্থান দিতাম না। মাধ্যমিকে একবার মাত্র এক নম্বরের ব্যবধানে দ্বিতীয় হয়ে যাওয়াতে মাথায় প্রথম হওয়ার ভূত চেপে বসলো। ফলাফল পরের ক্লাসে কুড়ি নম্বরের ব্যবধানে হয়ে গেলাম প্রথম এবং যথারীতি আমি আবার প্রথম হওয়ার ইচ্ছা পরিত্যাগ করলাম। আমার সবচেয়ে ভালো ফলাফলের সময় হচ্ছে কলেজ জীবনটা, কারণ কলেজে আমাদের নিয়মিত পড়াশুনার কোন চাপ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হওয়াতে বছরের বেশিরভাগ সময়ই সেটা বিভিন্ন ঘটনা-দূর্ঘটনার কারণে বন্ধ থাকতো। যার ফলে মনের মাধুরি মিশিয়ে পড়াশুনা করলাম, এবং ফলাফল আমার নাম আবার নোটিস বোর্ডে। আর জীবনের সবচেয়ে বিভিষিকাময় সময় হচ্ছে বুয়েট জীবন, আবার একই সাথে বুয়েট জীবন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনের সময়ও, কিছু ফেরেশতাতুল্য বড় ভাইয়ের সাথে পরিচয় হল।

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ (ছবিঃ লেখক)[1]

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ (ছবিঃ লেখক)

আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক হচ্ছে প্রকৃতি আর তথাকথিত গায়ের রক্ত পানি করে দুবেলা অন্ন যোগাড় করতে আহোরাত্রি ব্যস্ত সাধারণ মানুষ। প্রকৃতি আমাকে শিক্ষা দিল মানুষের সহ্য ক্ষমতা কতখানি হওয়া উচিৎ আর সাধারণ মানুষগুলা শিক্ষা দিল সামান্যে কতখানি সুখি হওয়া যায়। আমি সবসময়ই এই দুইয়ের শিক্ষা আমার জীবনে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। তাই জীবনের প্রতিটা মূহুর্ত উপভোগ করার চেষ্টা করেছি সেটা যত খারাপ অবস্থাতেই হোক না কেন। আমি সবসময়ই চেষ্টা করেছি তারও একটা ভালো দিক বের করার। আর এই শিক্ষা দিয়েছিলেন আমার বড় ভাই কাম বস “মোহাম্মাদ মিনহাজ মাহদি”। উনি বলতেন, তুই খারাপ মানুষদের সাথে কাজ করলে এভাবে চিন্তা করবি যে পৃথিবীর কোথাও যেয়ে তুই ঠকবি না। এবং ভালো মানুষদের সাথে কাজ করাটা অনেকটাই ডাল-ভাত হয়ে যাবে। মিনহাজ ভাইয়ের তথ্যভাণ্ডার ছিলাম আমি, উনার জিআরই’র নিবন্ধন করা থেকে শুরু করে উনার ভিসা প্রাপ্তি সবই আমার সাথে শেয়ার করতেন আর আফসোস করতেন এই বলে যে “এই ভূদাই তুই কবে বিদেশ যাবি?” অনেকদিন মিনহাজ ভাইয়ের সেই মধুর ডাকটা শুনি না? আজ মিনহাজ ভাই বেচে থাকলে অনেক খুশি হতেন আর বলতেন আরে আমার ভূদাইটা তো দেখি মানুষ হয়ে গেছে, একে তো আর ভূদাই বলা যাবে না! আজ নিশ্চয় মিনহাজ ভাই স্বর্গে বসে মিটিমিটি হাসছেন আর আমার কর্মকান্ড অবাক বিস্ময়ে দেখছেন।

তবে খারাপ লাগে এই অভাগা দেশটার জন্য কিছুই করতে পারলাম না, পারলাম না কিছুই করতে এই দেশটার আরো বেশি দূর্ভাগা মানুষগুলোর জন্য যাদের দেয়া ট্যাক্সের টাকায় প্রায় বিনি পয়সায় পড়া শুনা করালাম। প্রকৃতি এই দেশটাকে একেবারে দু-হাত ভরে সৌন্দর্য বর্ধনের সকল উপাদান কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। আপনার মায়ের শরীরে ব্লাড ক্যান্সার, আর যেহেতু সারবে না তাই বলে নিশ্চয় আপনি তার চিকিৎসা বন্ধ করে দিবেন না বরং আপনার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যাবেন তাকে সারিয়ে তোলার। যদিও আপনি জানেন সেটা অসম্ভব। চাকুরী জীবনের সামান্য অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাংলাদেশের প্রত্যেকটা জায়গায় দূর্ণীতি, যারা দূর্ণীতি নিয়ে বেশি বেশি চায়ের কাপে ঝড় তুলতেছে আসলে তারাই বেশি বেশি দূর্ণীতি করছে। তাই কোনভাবেই কোন চিকিৎসাতেই এর দূরীকরণ সম্ভব না, যেমন সম্ভব না ব্লাড ক্যান্সারের রোগীর ক্যান্সার সারানো। যদি শরীরের সমস্ত রক্ত বের করে দিয়ে আপনি একেবারে ফ্রেশ রক্ত আবার পুশ করতে পারেন তবেই এর নিরাময় সম্ভব, কিন্তু সেটা করতে গেলে রোগী আর জীবিত থাকবে না।

কঠোর পরিশ্রমি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ (ছবিঃ লেখক)[2]

কঠোর পরিশ্রমি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ (ছবিঃ লেখক)

তাই দূর হতে শুধু এই অধম একটা দোয়া করে যাবে, ভালো থেকো আমার মা, ভালো থেকো বাংলাদেশ।

১২ই মার্চ ২০১৫ – দেশ ছাড়ার আগেরদিন লেখা।।

Endnotes:
  1. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2017/12/bangladesh-nature.jpg
  2. [Image]: http://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2017/12/general-people.jpg

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2017/%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%8b-%e0%a6%a5%e0%a7%87%e0%a6%95%e0%a7%8b/