by Priyo Australia | July 16, 2016 9:08 am
ইশরাত আখন্দের মুখ এখনও চোখের সামনে ভাসছে। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলত। বাংলাদেশে মাইম একাডেমি নিয়ে আমার স্বপ্নের কথা জানত সে। একসঙ্গে আমরা কাজ করব, এমন পরিকল্পনা ছিল। গত ১৩ নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। বিশ্ব সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত প্যারিসের ক্যাফে ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। সবচেয়ে বড় হামলা হয় বাতাক্লান থিয়েটারে। সেখানে থাকা সবাইকে জিম্মি করা হয়। নিহত ১২৮ জনের ৮৯ জনই ছিল এ থিয়েটারে আসা দর্শক ও কর্মী। এ আক্রমণকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘটে যাওয়া ফ্রান্সের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হামলা হিসেবে মনে করা হয়। ঘটনার পর ফ্রান্সে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়, যা ১৪ জুলাই বাস্তিল দিবসেও বহাল ছিল। ফোনে এবং ফেসবুক বার্তায় ইশরাতের উদ্বেগ_ তুমি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। নানা স্থানে অনুষ্ঠান করতে যাও। কী উৎকণ্ঠা নিয়ে যে সময় কাটছে! দ্রুত উত্তর দাও। এরপরই তার ফোনে মন্তব্য- এক সময় দেখবে আমিও নেই, সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে চলে গেছি তোমাদের সবার কাছ থেকে বহু দূরে। তার বার্তার কথা মনে হলেই শিউরে উঠেছি। ১ জুলাই সেই অভিশপ্ত রাতে ঢাকার হলি আর্টিসান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলায় তার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শোনার পর বারবার মনে হয়েছে- ইশরাত কি বুঝতে পেরেছিল- হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে কেউ কোথাও নিরাপদ নয়!
হলি আর্টিসানে আমরা হারিয়েছি ইতালি, জাপানি ও ভারতীয়দের। বাংলাদেশের তরুণ ফারাজ আইয়াজ হোসেনের মৃত্যু নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি। তিনি বিদেশি বন্ধুদের ছেড়ে আসতে চাননি। তাই ঘাতকরা তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। বাঙালিরা অতিথিপরায়ণ হিসেবে পরিচিত। বিদেশিরা বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসে অতিথিপরায়ণতার কথাই বেশি করে বলে। গ্রামের সহজ-সরল স্বাভাবিক মানুষেরা নিজেরা না খেয়ে অতিথির সামনে খাবারের থালা তুলে দেয় যে! এটা কী করে মেনে নিই যে সেই বাংলাদেশে বিদেশিদের গুলি করার পর চাপাতির আঘাতে পৈশাচিক উপায়ে হত্যা করা হয়েছে? কী তাদের অপরাধ ছিল? এর আগে সংখ্যালঘুদের ওপর একের পর এক আঘাত এসেছে। এমনটি বহু বছর ধরে ঘটছে। কারও কারও কাছে এটা যেন গা সওয়া ঘটনা। কিন্তু এভাবে বিদেশিদের হত্যার ঘটনা অতীতে ঘটেনি। ৩৫ বছর ধরে দেশের বাইরে আছি। ১ জুলাইয়ের ঘটনার পর যে হাহাকার অনুভব করেছি, আগে এমনটি হয়নি। আমি ছোট্ট খারাপ খবরেও ভেঙে পড়ি। ১৪ জুলাই বাস্তিল দিবসে রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিসে হামলার ঘটনা শুনি। যত রাত বেড়েছে, মনটা ভারি হয়েছে। এ সময়ে একের পর এক ফোন এসেছে। ইশরাত আখন্দ বেঁচে থাকলে তারও ফোন পেতাম, সন্দেহ নেই। বারবার ওর কথা মনে পড়ছিল। আরও উদ্বিগ্ন ছিলাম আমার ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে। বাস্তিল দিবস ছিল বৃহস্পতিবার। পরদিন শুক্রবার। অনেক অফিস এ দিন ছুটি দেওয়া হয়, যাতে কর্মীরা শনি ও রোববার মিলিয়ে একটানা চারদিন ছুটি কাটাতে পারে। আবার কেউ কেউ শুক্রবার ছুটি নিয়ে নেয়। আমার ছেলে ও মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেছে। তাদের সংবাদ পেতে কেটে গেছে কয়েকটি উদ্বিগ্ন ঘণ্টা।
গত বছরের নভেম্বরের হামলা ফ্রান্সের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কয়েকদিন আগে শেষ হয়ে গেল ইউরো ফুটবল। এ আয়োজন যাতে নির্বিঘ্ন হয়, সেজন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা চালায় সরকার। চারদিকে সাজ সাজ রব। রাশিয়া ও ব্রিটেনের দর্শকদের কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা ছাড়া নির্বিঘ্নে এ প্রতিযোগিতা সম্পন্ন হওয়ায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান। কিন্তু অলক্ষ্যে হানা দিল ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসী। একটি ট্রাক হয়ে উঠল অন্তত ৮৪ জনের ঘাতক। কী করে এটা সম্ভব হলো? নিসের উৎসব আয়োজনে কোনো বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ইউরো ফুটবলের আসর শেষ হওয়ায় সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। এর সুযোগই কি নিয়েছে ট্রাকচালক? ঘাতকের পূর্বপুরুষ তিউনিসিয়ার। তবে সে বেড়ে উঠেছে ফ্রান্সে। লেখাপড়াও ফ্রান্সে। তাকে পুলিশ হত্যা করেছে। যে গাড়িটি নিয়ে সে উন্মত্তের মতো প্রায় দুই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে একের পর এক মানুষকে পিষ্ট করেছে সেটি নিয়ে চলছে পরীক্ষা। বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সমুদ্রসৈকতের একটি হচ্ছে নিসের এ সৈকত। ভূমধ্যসাগারের নীল জলরাশি আছড়ে পড়ে এখানে। এক পাশে মোনাকো, আরেক পাশে মন্টিকার্লো, আরেক পাশে বিখ্যান কান। এই কানের চলচ্চিত্র উৎসব বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক উৎসবের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃত। ফ্রান্স পর্যটনের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু ১৩ নভেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর এ আয়ে ধস নেমেছে। বড়দিনে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম পর্যটক এসেছে। এই নিসেই রয়েছে সৌদি বাদশাহর নিজস্ব প্যালেস। তিনি যখন স্বজন ও পারিষদদের নিয়ে এখানে ছুটি কাটাতে আসেন তখন অন্য সব পর্যটকের জন্য সৈকত এলাকা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে ফ্রান্সে অনেক সমালোচনা। কিন্তু রাজস্ব আয় বলে কথা! সৌদি বাদশা যখন তার দলবল নিয়ে আসেন তখন সব ব্র্যান্ড কোম্পানি তাদের সেরা পণ্য নিয়ে হাজির হয় সেখানে। এমন ব্যবসার সুযোগ কেন হাতছাড়া করবে ফরাসি সরকার? এ সৈকতে বিশ্বের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সেরা নায়ক-নায়িকাদের ভিড় জমে। এবারের বাস্তিল দিবসের উৎসবে তাই প্রত্যাশা ছিল- ১৩ নভেম্বরের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যেতে হবে। পর্যটন ব্যবসা আবার জমজমাট হবে। ইউরো ফুটবল আসর দিয়ে তারা নিজেদের শান্তিপূর্ণ ও সাংস্কৃতিক ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিল এবং তাতে বহুলাংশে সফল। আতশবাজির খেলা দেখে মনে হচ্ছিল- চার মাস ধরে দেশটি যেভাবে শোকে নিমজ্জিত ছিল, তা কেটে গেছে। কিন্তু মুহূর্তে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল যে! ১৩ নভেম্বরের হামলার পর অনেক দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী রাজধানী ফ্রান্সের কেন্দ্রস্থলে এসে মানববন্ধন রচনা করেন। তাদের চারপাশে ছিলেন লাখ লাখ মানুষ। তারা এসেছিলেন ফ্রান্সের প্রতিটি প্রান্ত থেকে, নানা দেশ থেকে। তারা বলেছিলেন- আর সন্ত্রাস নয়। মানুষের শপথ ছিল- সন্ত্রাসকে রুখবই। এখন এ দেশটি কী করবে?
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ বলেছেন- আমাদের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানা হয়েছে। আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাত হানা হয়েছে। মানবাধিকারের ওপর আঘাত হানা হয়েছে। এর জবাব দেশটি কীভাবে দেবে?
নিসের সৈকত এলাকায় গাড়ি চলাচল করে না। সাইকেলও চলে না। মানুষ হেঁটে বেড়ায়। কী করে সব বাধা অতিক্রম করে একটি বড় ট্রাক সেখানে পেঁৗছতে পারল? এবারে আবহাওয়া চমৎকার। রাত পৌনে ১০টার আগে সূর্য অস্ত যায় না। সূর্যের আলোয় শরীর সিক্ত করতে অগণিত নারী-পুরুষ সেখানে হাজির থাকে। এক সন্ত্রাসী সেই সূর্যের আলো নিভিয়ে দিল মুহূর্তে। তার পেছনে কে আছে, ক্রমশ স্পষ্ট হবে। সন্ত্রাসীর তালিকায় তার নাম পায়নি ফরাসি পুলিশ। তার স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সন্দেহ নেই সে হতাশাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু সে কি কেবল হতাশা থেকেই এমন ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত করেছে? ফরাসি কর্তৃপক্ষ বলছে- এটা সন্ত্রাসী হামলা। তাদের কমান্ডো বাহিনী বিশ্বখ্যাত। দুর্ভেদ্য এলাকায় হানা দিয়েও জিম্মি উদ্ধারের জন্য পরিচিত। কিন্তু তাদের পক্ষেও একজন হামলাকারীকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়নি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে- তাহলে নিরাপত্তা কোথায়? ঘরে, সৈকতে, ক্যাফেতে, থিয়েটারে কিংবা গাড়িতে, কোথায় আমরা নিজেদের ভাবতে পারব- অন্তত এখানে কোনো সন্ত্রাসী দানব হানা দেবে না? এ উদ্বেগ ফ্রান্স, বাংলাদেশ এবং ইরাক, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের সর্বত্র। ফ্রান্সের কোটি কোটি মানুষ এখন শোকার্ত, নির্বাক ও স্তম্ভিত। তাদের প্রতি আমাদের সমবেদনা। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ নিসের সৈকতে নিহত বা আহত হয়েছেন বলে শুনিনি। কে কোথায় কীভাবে উন্মত্ততার শিকার হবেন, কেউ জানি না। সতর্ক হতে চাই। নিরুদ্বেগের জীবন চাই। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ এজন্য শুভবুদ্ধির সব মানুষকে হাত মেলাতে বলেছেন। প্যারিস কিংবা নিসে আবার হয়তো আসবেন বিশ্বনেতারা। আইফেল টাওয়ারের কাছে কিংবা সূর্যালোকে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশির পাশে দাঁড়িয়ে তারা শপথ নেবেন। আমরা তাতে শরিক হবো। সভ্যতার জন্য এক মস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমরা। তাতে যে জয়ী হতেই হবে।
ফ্রান্স প্রবাসী আন্তর্জাতিক
খ্যাতিসম্পন্ন মাইম শিল্পী
Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2016/%e0%a6%ab%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%95-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%ad%e0%a6%bf/
Copyright ©2024 PriyoAustralia.com.au unless otherwise noted.