শুভদিনের পদধ্বনি – ডা. নুজহাত চৌধুরী

by Priyo Australia | December 14, 2015 10:29 pm

আজন্ম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের কাছে এসেছে শোক, অভিমান, ক্রোধ, হতাশা ও দীর্ঘ বঞ্চনার প্রতিভূ হিসেবে। স্বজন হারানোর বেদনা ছাপিয়ে এই দিনটিতে বিমর্ষ থেকেছি ভালোবাসার স্বদেশের পথ হারিয়ে ফেলে অধ:পতিত হবার ভগ্ন চেহারা দেখে। ভুলুণ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের হতাশ করেছে; ক্ষমতায় অধিষ্টিত পিতৃহন্তারকয়েদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা আমাদের ব্যঙ্গ করেছে। কিন্তু গত কটি বছরই অন্য রকম।

যে দিন থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে স্থান করে নিল, সেদিন থেকেই আরও আশায় বুক বেঁধে চলা। তারপর একে একে সমস্ত শঙ্কা, আলোচনা ও বিরুদ্ধ মত ভুল প্রমাণ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি বাস্তব রূপ ধারণ করল একটি ট্রাইব্যুনালের আকারে।
তারপর যে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় দেখেছি, তাদের ত্রাসে তটস্থ থেকেছে যে দেশ, সেই বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময় দেখলাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। যা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি সে সুদিন যে সত্যি এল তা এখন মাঝে মাঝে বিস্বাষ হতে চায় না।

কারণ আমরা যারা একাত্তরে স্বজন হারিয়েছি, তারা বড় হয়েছি পঁচাত্তর-পরবর্তী এক অন্ধকার সময়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রতমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর, সেই সঙ্গে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর স্বজন-হারানো আমরা হলাম অভিভাবকশূন্য। মুখ থুবড়ে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ক্যান্টনমেন্ট থেকে গজিয়ে ওঠা ভুঁইভোড় রাজনৈতিক দলে আশ্রয় ঘটল সকল রাজনৈতিক উচ্ছিষ্টদের। রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি জায়গা করে নিল যুদ্ধাপরাধী খুনি ধর্ষকরা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলল ইতিহাস ভুলিয়ে দেবার এক কালো অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যাবে না, বলা যাবে না জয় বাংলা– সে এক দুর্বিষহ সময়! ভাবখানা তাদের এমন ছিল যে, দেশে কোনো যুদ্ধপরাধই সংঘটিত হয়নি। মুজাহিদ তো দম্ভভরে বলেই ছিল, “কীসের যুদ্ধাপরাধ? এদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধ হয়নি।”

সেই বাংলাদেশে আজ আমরা শুধু যে যুদ্ধাপরাধ হয়েছে তা প্রমাণ করতে পেরেছি তা নয়, পেরেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে, তাদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে– এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে শহীদ-স্বজনদের জন্য?

আর তাই আমরা সন্তুষ্ট, আবেগাপ্লুত, এদেশ নিয়ে গর্বিত। এদেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। বাঙালি সত্যি বীরের জাতি। তারা যুদ্ধ করতে জানে, যুদ্ধে জয়ী হতে জানে, পিতৃপুরুষের হত্যার বিচার করতে জানে। এ জাতিকে ঠেকিয়ে রাখবে কে? বঙ্গবন্ধুর সেই কথাই বলি, ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’

শুধু কি তাই? শুধু কি অতীতের জঞ্জাল আমরা সরিয়ে ফেলছি? না, তা নয়। আমরা দৃপ্ত পদে এগিয়ে যাচ্ছি তেমনটি আমার বোধ হচ্ছে। মাত্র এক দিন আগে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হল। কারও সহায়তা ছাড়া, সকল ষড়যন্ত ধ্বংস করে, নিজ অর্থায়নে আমরা সত্যিই গড়ে তুলতে যাচ্ছি এমন একটি সেতু ভাবতেই গর্বে মন ভরে যায়। তাই সত্যিই প্রত্যয় জন্মেছে যে, সামনে আসছে সুদিন। আমি একটি সুন্দর ভব্যিতের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। যদি নেতৃত্ব থাকে দৃঢ়চেতা আপোষহীন বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে, যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি একত্র থাকে, যদি তারুণ্য এমন স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত থাকে, তবে কোনো কারণ সেই প্রদেশের সামনে এগিয়ে না যাবার।

তাই এবারের ১৪ ডিসেম্বর আমাদের কাছে ভিন্নতর। ব্যক্তিগত শোকে আমি কাঁদি, কিন্তু তা কখনও আমার কাছে মুখ্য ছিল না। আমাদের কোনো শহীদ-স্বজনের কাছেই ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া বড় নয়। সব সময় শহীদ-স্বজনরা দেশের জন্যই হতাশ হয়েছে, কেঁদেছে, শঙ্কিত হয়েছে। তাই আজ শঙ্কা, ক্রোধ, হতাশা ভেদ করে, অহংকার গর্ব, কৃজ্ঞতার সঙ্গে এসেছে নতুন অনুভুতি– এক বুকভরা আশা দেশকে নিয়ে। আমি সত্যিই শুনতে পাই শুভদিনের পদধ্বনি।

এখনও অনেক দূর যেতে হবে। এখনও অনেক কাজ বাকি। ভুলভ্রান্তি হচ্ছে প্রচুর। এখনও চলছে ষড়যন্ত্র। প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তার বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে বাংলার মাটিতে। এখনও পাকিস্তানের অনুচরেরা ষড়যন্ত্রের হাল বিছিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আশঙ্কা যে নেই তা নয়, দৈনন্দিন ভুলভ্রান্তিতে বিপর্যস্ত যে হব না তা-ও নয়। তবু বলব, মেঘের আড়ালে সূর্যের আলো দেখতে পাই আমি। তবু বলব, সুদিনের পদধ্বনি শুনি। পথ নিশ্চিতভাবেই সহজ হবে না। কিন্তু এ পথও পাড়ি দেওয়ার সাহস, সংকল্প, দৃঢ়তা বাঙালির আছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাঙালি পেরেছে, বাঙালি পারবে। আমরা যখন একাত্তরে জয়ী হতে পেরেছি, সব যুদ্ধে জয়ী হতে পারব। তাই এই ১৬ ডিসেম্বরে শোক ছাপিয়ে অহংকার, কান্না ছাপিয়ে আশায় আমার বুক ভরে পাছে।

আজকের দিনে সকল শহীদকে শ্রদ্ধা জানাই। আর এদেশের প্রত্যেক বাঙালির জন্য অভিবাদন।

ডা. নুজহাত চৌধুরী: সহযোগী অধ্যাপক (চক্ষু), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

Original post at bdnews24.com[1]

Endnotes:
  1. bdnews24.com: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/33686

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2015/%e0%a6%b6%e0%a7%81%e0%a6%ad%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%a6%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%a1%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a7%81%e0%a6%9c%e0%a6%b9/