মুক্তিযুদ্ধে নতুন প্রজ্ম্ম: ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক অবিরাম সংগ্রাম

by Farid Ahmed | March 1, 2013 9:39 pm

পহেলা মার্চ। দিনটি আমার জীবনে অবিস্মরনীয় হয়ে আছে। আজ থেকে ৪২ বছর আগে এই দিনে একবুক স্বপ্ন নিয়ে আমি আমার আব্বার হাত ধরে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হলাম। সে এক অজানা স্বপ্ন। এক অনির্বচনীয় অনুভুতি! সেদিন ছিল বসন্ত। কিন্তু গ্রামে তখনও কিছুটা শীত ছিল। বাবা-মার স্বপ্ন তাঁদের সন্তান একদিন মানুষ হবে, তাঁদের সুদিন আসবে। আর সেই স্বপ্ন পূরণেই গ্রাম ছেড়ে শহরে। কিন্তু সেদিন যেভাবে প্রত্যাশা নিয়ে আমি শহরমুখী হয়েছিলাম, তা আজও পূরণ হয়নি। কারণ, আজ আমি প্রবাসী। নিজ দেশে সবার সঙ্গে সুন্দর একটা জীবনই ছিল সেদিনের স্বপ্ন। আমি আজও সেই স্বপ্ন দেখি। নতুন প্রজম্মেও মুক্তিযুদ্ধ আমাকে আরোও আশাবাদী করে তোলে।

আজ আমি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে। এখানে আজ থেকে হেমন্তকাল শুরু হল। সুন্দর একটা সকাল। এই সুন্দর পরিবেশ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল বাংলাদেশে। আমার বাংলাদেশওতো এমন সুন্দর। অথচ! একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি আবারও একবুক স্বপ্ন নিয়ে আমার সন্তানকে স্কুলে দিয়ে এলাম। আজ যে যুদ্ধ নতুন প্রশ্ন শুরু করেছে তা সফল হবেই। আমাদের স্বপ্ন, স্বপ্ন সত্যি হয়ে উঠবে! আমার সে স্বপ্ন: আমার সন্তান দেশে ফিরে বাঙলার মুখ উজ্জল করবে যেমনটি আমার বাবা দেখেছিলেন।


আজ সবাই যেমন বলে দেশ থেকে পালা! পালা! এখানে আসলে যেমন জানতে চায় কেন দেশে ফিরবে? সেদিন দেশ থেকে ডাকবে ফিরে আয়! ফিরে আয় বাংলার সন্তান! আমরা দেশে ফিরে যাব! বুক ভরে আমরা নি:শ্বাস নেব! বাংলাদেশ হবে শান্তির দেশ! আমার বিশ্বাস নতুন প্রজ্ম্ম পারবে সেই বাংলাদেশ গড়তে যা আমার আজও পারিনি। তখন আমার সন্তান বলবে, আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, আমি প্রজম্ম চত্তরে যেতে পারিনি, তবে মেলবোর্ণে ফেডারেশান স্কয়ারে গিয়ে প্রতিবাদ করেছি, বলেছি যেন ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, যুদ্ধাপরাধীর যেন ফাঁসি হয়। আমি আবার ফিরে যাব আমার সেই সবুজ বাংলার বুকে। জয় হোক নতুন প্রজম্মের এ মুক্তিযুদ্ধ।

আমি আজ আবার প্রবাসী! আমিতো এদেশে আবার ফিরে আসতে চাইনি। প্রথমবার যখন এদেশে যখন এসেছিলাম তখন দেশপ্রেম আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো। আর তাই প্রতিক্ষায় কাটতো আমার দিন রাত। দেশকে মুক্ত করতে হবে, রাজাকারদের হাত থেকে নতুন কওে এ ছিল আমরা স্বপ্ন। আর তাই পত্রিকার প্রকাশনা রেডিও নিয়ে আমাদের সময় কাটতো। যখন তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এল তখন দেশে ফিরে গেলাম, বিশ্বাস করলাম মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত পক্ষ পরাস্থ হয়েছে। দেশে ফেরার স্বপ্ন ছিল কারণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা পেয়েছি। ওই দেশটিই কেবল আমার। একান্ত আমার। এই দেশতো ওই আদিবাসিদের যারা আজও অধিকার বঞ্চিত। ওরাতো আমাকে চায় না। তাছাড়া, দেশ গরীব মানুষের অর্জিত টাকা দিয়ে আমাকে বিদেশ পাঠিয়েছে। দেশে ফিরে দেশকে আলোকিত করবো- এ প্রত্যাশা থেকেইতো আমাকে বিদেশ পাঠানো। বাবা-মার পাশে থাকবো। জামায়ত-বিএনপির কথা শুনলে মনে হয় শাহবাগই আমাদের সর্বস্ব। কিন্তু দেশটাতে আজ কি হচ্ছে? আবার সারাদেশে শিবিরের তান্ডব! আমাদের সকল সমর্থন কি কেবল শাহবাগ? আমাদের সকল শক্তি কি শাহবাগ? না! আমাদের শক্তি সারাদেশ, সারা বিশ্বব্যাপী। আমাদের এ যুদ্ধে জিততে হবে। সংগ্রাম ও সোনার বাংলা শব্দ দুটি আজ জামায়ত হাইজ্যাক করেছে। ওদের হাত থেকে আমার সোনর বাংলা মুক্ত হবেই হবে। আজ তাদের অনৈতিক কর্মকান্ডকে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে যারা তারা নব্যরাজাকার। সেই নব্য রাজাকার থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করতে হবে।

২০০৬ সালে ওরা বন্দুক হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। সেদিন জনতার পাশে সেনাবাহিনী দাঁড়িয়েছিল। আর তাই দ্রুত দেশে ফিরে যেতে চেয়েছি। ২০০৭ যখন দেশে ফিরবো বলে প্রস্তুত হচ্ছি তখন কামরুল ভাই বললেন, তুমি দেশে যাচ্ছ, তোমাকেতো জেলে নিতে পারে। আমি বলেছিলাম, না পারবে না। এরপর এল সেই ২৯শে ডিসেম্বর ২০০৮। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ক্ষ শক্তির বিজয় হল। মনে হল দেশটা আবার স্বাধীন হল। কিন্তু ওরা আবার আরেক ২৫শের সকালে আঘাত হানলো। রক্তের বন্যা বয়ে গেল বিডিআর সদর দপ্তরে। কি প্রচন্ড আঘাত! যে বিডিআর প্রথম অস্ত্র ধরেছিল স্বাধীনতার জন্য সেই বিডিআরে রক্তের বন্যা! আর পার্লামেন্টে বসে সাকা চৌধুরীর আস্ফালন! আমি ভীত হয়ে উঠলাম! দেশ কি তাহলে এখনও ওই রাজাকারদের হাতে বন্দি! আমি দেখলাম অনেক রাজাকার- জামায়ত- শিবির ক্ষমতার কাছাকাছি। তাদের নিয়ে উচ্চাভিলাসী চিন্তা কোন কোন নেতার। ওদেরকে পদে রেখে দেখাতে চান বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ভাল। এই আদর্শের মানুষ গুলো ভাল! আমি শিঊরে উঠলাম! নেতারা হয়তো ভালই আছেন! তবে, আমার জীবনে এল প্রচন্ড আঘাত! সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়েও আমি পরাজিত হলাম জামায়ত-শিবিরের কাছে, সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে! কি চরম শাস্তি নিজ আদর্শের মানুষের কাছ থেকে!

সেখানেই যদি শেষ হতো! তাহলে হয়তো…! কিন্তু একদিন প্রভাতে এক জামায়ত নেতা এক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষককে নিয়ে আসলেন আমার অফিস কক্ষে। আমাকে পদত্যাগের পরামর্শ দিলেন! আমি হতবাক হলাম কিভাবে একজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নতি স্বাীকার করতে বলে অনৈতিক দাবীর কাছে। এবারও জামায়ত জয়ী হল! বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তি ভেবে ছিলেন, আমি সরে গেলে তিনি নিরাপদ থাকবেন, তাই তিনি ওই জামায়ত নেতাকে খুশি করতে চাইলেন। কিন্তু মাত্র ২ মাস তিনি ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন! এসব লেখার উদ্দেশ্য ওরা কত শক্তিশালী তা বোঝাবার জন । নতুন প্রজম্ম হয়তো এসসব জানেই না! আর তাই হয়তো একটু বেশী উচ্ছসিত। কিন্তু আমি আতঙ্কিত! ওরা সব পারে! ১৯৭১ সালের পরও কিন্তু জামায়ত নতুন করে আবাসন করে নিয়েছিল ওই জিয়ার মত পথ ভ্রষ্টদের সহায়তায়। আমার মত যেন তোমরা হেরে না যাও। খালেদা জিয়া বিশ্বাস করতে পারেন না, ওই জামায়ত তার র্সবনাশের বাঁশি বাজিয়েছিল। আর তাই হাসপাতালে, বাসায় জাময়ত নেতাদের দেখতে যান। জনসভায় দাঁড়িয়ে তাদের মুক্তির কথা বলেন। জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যারা আস্ফালন করছে তাদেরকে তিনি এখনও উৎসাহ দিচ্ছেন।

১৯৭১ সালের এই মার্চ মাসে যখন গ্রাম ছেড়ে শহরে এলাম তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। স্বাধীনতার প্রশ্নে তখন কোন বিরোধ আছে বলে নজরে পড়েনি। সবাইতো দেশ স্বাধীন হোক চেয়েছে। তবে কেন আজ সংবাদ পড়তে হল: দুই পুলিশসহ ৬০ জন নিহত। এ কোন বাংলাদেশ? কেন এমন হল। ১৯৭১ সালে হটাৎ করে কিছু মানুষ অস্ত্রতুলে নিল। তারা নিজেদের পরিচয় দিল: রাজাকার। পাকিস্তান রক্ষা করতে তারা অস্ত্র ধরেছে। পাকিস্তান কেন রক্ষা করতে নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র তুলে নিল তা তখন বুঝিনি। তবে, তাদের ধারণা বাংলাদেশ হলে ইসলাম থাকবে না। আজও তারা সেই বিশ্বাস নিয়ে কাজ করছে। তারা বলছে বাংলাদেশে ইসলাম আক্রাত, ভারতকে খুশি করতে সরকার এ আন্দোলন করছে, ইত্যাদি। কেন তাদের বিশ্বাস ইসলামের মর্যাদা ও দেশের মান তারাই রক্ষা করতে পারে? এখানে আমাদের অুনসন্ধান আরোও গভীর ও নিবিড় করতে হবে।

তারা আজ মন্দির ভেঙ্গেছে। কেন তাদের এই অধ:পতন? আমি নিজে ইসলাম নিয়ে গবেষণা করেছি। কিন্তু তারা যে ইসলামের কথা বলে সে ইসলামতো প্রকৃত ইসলাম নয়। তারা জিহাদ ও সন্ত্রাস দিয়ে জয় করতে চায়। তাছাড়া যুদ্ধ ও সন্ত্রাস এক নয়। ইসলামতো সন্ত্রাস ও গুপ্ত হামলা সমর্থন করে না। তবে কেন তারা পথভ্রষ্ট? আমি উওর খুজে পাই না। তবে, অনুমান করতে পারি। আর তাহল: প্রতিশোধ নেবার বাসনা ও ক্ষমতায় চড়া। ১৯৭১ সালে তাঁরা পরাজিত হয়ে দমেনি। নতুন করে তারা প্রতিশোধ নিতে চায়। তাঁদের চেতনায় কতকগুলি বিষয় নাড়াচাড়া দেয়। তখন তারা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই তারা শিবির করে, জামাত করে। এখানে তাদের ক্ষমতার চেতনা ও সম্পদের লালসা তাদেরকে গ্রাস করে।

আজ নতুন প্রজম্ যে মুক্তিযুদ্ধ করছে সে ওই মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় নতুন প্রজম্মেও মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ কোনদিন শেষ হবে না। এ মুক্তিযুদ্ধ ন্যায় প্রতিষ্ঠার মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ কেবল তখনই শেষ হতে পারে যখন তাদের( শিবির-জাময়ত) হৃদয়ে জ্ঞানের আলো পৌছাবে। যেদিন তারা আলোকিত মানুষ হতে পারবে সেদিন তারা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের পথ ছেড়ে শান্তির পতাকা ওড়াবে। যতদিন তাদের আলোকিত করা সম্ভব হবে না ততদিন তারা লড়াই করে যাবে। আমাদের এবারের সংগ্রাম হোক দেশের সকল মানুষকে আলোকিত করবার সংগ্রাম। এ সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম। ন্যায় একদিন প্রতিষ্ঠা পাবেই। আমি আবার দিপ্ত কন্ঠে বাংলার বুকে উচ্চারণ করবো এ দেশ আমার । এদেশে আমাদের সকলের।

ফরিদ আহমেদ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2013/%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a7%e0%a7%87-%e0%a6%a8%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%ae/