by Mainul Raju | July 28, 2013 9:07 pm
তিন প্যারার গল্পঃ জন্ম যদি তব বঙ্গে
লিখেছেন মইনুল রাজু
তারপর, কোনো এক সন্ধ্যায় আমরাও ভীড় করি বিমানবন্দরের বহির্গমন টার্মিনালে, পাড়ি দিই অচেনা-অজানা গন্তব্যে। অনেক অনেক দিন পরের আরেক সন্ধ্যায়, কোনো এক ভিনদেশি জানতে চায়, কোন দেশ থেকে এসেছ? আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে উত্তর দিই- বাংলাদেশ। দ্বিগুণ পরিমাণে ভ্রুকুঞ্চণ করে ভিনদেশী আবারো প্রশ্ন করেন, সেটা আবার কোথায়?
না-ই জানতে পারে। এদেরকেতো আর বিসিএস পরীক্ষা দিতে হয়নি যে, রাজধানীসহ সব দেশের নাম মুখস্থ করে বসে থাকবে। তবু, অনেকে না জানলেও, অনেকে আবার বেশ ভালোভাবেই জানেন। চলার পথে নিজ দেশ নিয়ে, ভিনদেশীদের সাথে হওয়া কিছু মিশ্র অনুভূতির অভিজ্ঞতা নিয়েই লেখা তিন প্যারার ছোট্র এই তিন গল্প।
১.
শিকাগোর একটা প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আইটি চ্যালেঞ্জের আয়োজন করে থাকে। সেখান থেকে নির্বাচিতদের ফাইনাল রাউন্ডে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দেয়া হয়। ফাইনাল রাউন্ডে শিকাগোর বড় বড় সবগুলো কোম্পানি নিজেদের প্রচারণার জন্য বিভিন্ন ধরণের উপহার নিয়ে হাজির হয়। সেরকম এক প্রতিযোগিতায় সবার সাথে লাইন করে দাঁড়িয়ে আছি, উপহার হিসেবে দেয়া টি-শার্ট নেবার জন্য। প্রতিযোগিতার সময় সেই টি-শার্ট পরে থাকতে অনুরোধ করা হয়।
লাইনের সামনে থাকা, খুব সম্ভবত ইউরোপীয়ান আরেকজন প্রতিযোগী, আমাকে জিজ্ঞেস করলো- “তোমার দেশ কোথায়?” আমি বললাম, “বাংলাদেশ”। সে আকাশ থেকে পড়ে বলে, “এটা কোথায়?” বুঝিয়ে বললাম তাকে। সে বলে, “আমি জীবনে কখনো নামও শুনিনি।” মনে মনে ভাবছিলাম, নামও শোনোনি সেটা তোমার ব্যর্থতা। তারপর সে সীমা অতিক্রম করে বলে বসলো, “ডোন্ট ইউ গাইজ ডু এনিথিং ইম্পর্টেন্ট, হাউ কাম আই নেভার হার্ড অফ দ্যা নেইম অফ ইউর কান্ট্রি?”
তার সেই প্রশ্নের জবাবে কমপক্ষে দশটা উত্তর দিতে পারতাম। কিন্তু, একটা উত্তরও দিতে হয়নি, দেয়ার সুযোগ হয়নি। হাত বাড়িয়ে সে তার নিজের টি-শার্টটা নিলো। নিয়েই দেখার চেষ্টা করলো, মিডিয়াম না-কি লার্জ সাইজ। আর, তখনই চকচক করে ফুটে উঠলো তিন শব্দের মধুর সেই জাদুকরী লাইন- “মেইড ইন বাংলাদেশ”।#
২.
আমার নিজ ক্যাম্পাসে আমেরিকান একজন স্টুডেন্টের সাথে কথা হচ্ছিলো। তাকে হাজার হাজার ডলার ঋণ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হচ্ছে। আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে কত টাকা দিয়ে পড়তে হয় এখানে?” আমি জবাব দিলাম, “আমার টাকা দিতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় আমার টাকা দেয়।” সে অবাক হয়ে বলে, “দেখ তোমরা বাইরে থেকে এসে আমাদের ট্যাক্স এর টাকায় পড়ে যাচ্ছো। অথচ, আমরা লোন নিয়ে পড়তে হয়। আমার সরকার তোমাকে বিনে পয়সায় পড়াচ্ছে, অথচ আমি নিশ্চিত, তোমার সরকার তোমাকে বিনে পয়সায় পড়াতে পারেনি।”
সেখানে না থেমে আরো বলতে থাকে, “তোমার নিজ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য তোমাকে কত টাকা খরচ করতে হয়েছে।” আমি হিসেব-নিকেশ করে বললাম, “দুই ডলার”। সে বলে, “এক্সকিউজ মি”। তাকে এক্সকিউজ করে আরো জানালাম, “শুধু আমাকে নয়, আমার মত এরকম আরো হাজার হাজার স্টুডেন্টকে, আমার দেশ মাত্র দুই ডলারে পড়ায়।”
এবার সে বললো, “কিছু মনে করোনা, একটা কথা বলি।” আমি সন্মতি জানাতেই সে বললো, “তোমাদের দেশের সব মানুষ ঠিকমতো খেতেও পারে না, অথচ, আমি বুঝতে পারছি না, তারপরও কেন দেশের মানুষ হাজার হাজার স্টুডেন্টকে ফ্রিতে পড়াবে।” বললাম, “এবার তুমি কিছু মনে না করলে, আমি একটা কথা বলি।” সে বলো বলতেই জানালাম, “এই যে বললে বুঝতে পারছো না, সে বুঝতে পারছিনা কথাটা যেন না বলতে হয়, সে প্রত্যাশা নিয়েই আমার দেশে হাজার হাজার স্টুডেন্টকে ফ্রি লেখাপড়া করানো হয়।#
৩.
আমার কথা শুনে বয়স্কা ভদ্রমহিলা আস্তে করে চোখ মুছলেন। কে জানতো, আমার দেয়া সামান্য এক তথ্যই তার আবেগের জগতে এতটা নাড়া দিয়ে যাবে। পাঁচ সন্তানের মা তিঁনি। সবচেয়ে ছোট সন্তানের বয়সও পঁয়ত্রিশের উপরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। যুদ্ধ পরবর্তী পরিবর্তিত বিশ্ব দেখেছেন। এই পৃথিবীর অনেক অনেক রাজনৈতিক রাজত্ব আর অরাজকতার নীরব সাক্ষী তিঁনি। এখন মাইক্রোসফট্ এর গাড়ী ড্রাইভ করেন। আমাকে অফিস থেকে স্টেশানে নামিয়ে দিতে এসেছেন।
আজ থেকে অনেক বছর পূর্বে, ষাট কিংবা সত্তরের দশকে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা সে-রকম কোনো এক ম্যাগাজিনের কাভার পৃষ্ঠায় দেখেছিলেন, দূর্ভিক্ষ কবলিত বাংলাদেশের এক মা তার শিশুসন্তানকে সাথে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামান্য খাবারের আশায়। তারপর নিজে নিজেই বলে গেলেন, “আমার কোলেও তখন শিশু সন্তান, সেই ছবি দেখে আমার চোখের পানিতে আমার সন্তানের গা ভিজে গেছে। কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না, আমার মতনই আরেকজন মা তার সন্তানকে খাবার দিতে পারছে না।”
গাড়ী থেকে নামার সময় আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম বলার পর বললেন, বানান করে বলো। আমি বানান করে আমার নাম বললাম। তারপর বিদায় জানিয়ে বললেন, “আজকে অনেক বছর পর আবার তুমি আমাকে সে-দিনের কথা মনে করিয়ে দিলে। সে-দিন দুঃখে চোখ ভিজে গেলেও, আজ সুখে দু-চোখ ভিজে গেছে।” আমি খুব সাদামাটাভাবে তাঁকে শুধু বলেছিলাম, “বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, এখন আর কারো কাছে আমাদের খাবার চাইতে হয় না।”#
যখনই এধরণের কোনো ঘটনার মুখোমুখি হই, বাসায় এসে ইউটিউব খুলে বসি। তারপর অবিরত বাজতে থাকে- “সুন্দর, সুবর্ণ, তারুণ্য, লাবণ্য, অপূর্ব রূপসী, রূপেতে অনন্য, আমার দু-চোখ ভরা স্বপ্ন, ও-দেশ তোমারি জন্য”।
Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2013/%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%ae-%e0%a6%af%e0%a6%a6%e0%a6%bf-%e0%a6%a4%e0%a6%ac-%e0%a6%ac%e0%a6%99%e0%a7%8d%e0%a6%97%e0%a7%87/
Copyright ©2024 PriyoAustralia.com.au unless otherwise noted.