by Farid Ahmed | April 12, 2012 3:33 am
শিক্ষক রাজনীতি, শিক্ষার মান ও স্বায়ত্বশাসন
ড. ফরিদ আহমেদ, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শিক্ষার মান উন্নয়নে এবং নৈতিক মূল্যবোধপুষ্ট সুনাগরিক তৈরীতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করছেন । বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ এ ধরণের মুল্যায়নের অসারতা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। জোরালো দাবী নিয়ে উল্টো প্রশ্ন তুলতে পারেন অভিযোগকারী পক্ষের সততা ও জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে। বলতে পারেন কয়েকটি বিছিন্ন ঘটনা দিয়ে এমন একটি কঠিন মন্তব্য করা সমীচীন নয়। এ প্রসঙ্গে আমার অভিমত হল: বাস্তবতাকে অস্বীকার না করে আমাদের শিক্ষক সমাজের উচিত বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করা। কারণ স্বাধীনতার ৪০ বছর পার করেও আমরা একাবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকবেলায় তেমন অগ্রগতি লাভ করিনি। আজ যেখানে রাজনীতিবিদরা হরতাল ধর্মঘট ছেড়ে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনছেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ অবরোধ, বাস আটক, এবং পরীক্ষা বন্দের মত কাজে অংশ নিচ্ছেন। এসব থেকে এটাই প্রমাণিত হয়: শিক্ষক রাজনীতি আমাদের উন্নয়নের বাঁধা এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।
নৈতিক অবক্ষয়ের এক নিদারুণ চিত্র ফুটে ঊঠেছে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনামে। সংবাদটি পাঠ করে জানা যায়, সমাবর্তনে আগত ¯œাতকরা নিয়মের তোয়াক্কা না করে যেমন খুশি উপহার সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন। ¯œাতকদের এই নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে মাননীয় উপাচার্য বলছেন: “তোমাদের আমরা এই শিখিয়েছি; এই শিক্ষা দিয়েছি?”। অনলাইন পত্রিকাগুলিতে নৈতিক অবক্ষয়ের এবিষয়টি নিয়ে সংবাদ ছাপলে অসংখ্য পাঠক যেসব মন্তব্য করেছেন তাতে স্পষ্টত: প্রতীয়মান হয় শিক্ষক রাজনীতি নৈতিক অবক্ষয় ও শিক্ষার মানের অধগতির অন্যতম কারণ।
আমাদের শিক্ষার মান সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমার এক সহকর্মী সততার পরিচয় দিয়ে বলেই ফেললেন, যে পরিমাণ পড়াশোনা করে ও ইংরেজী শিখে বিদেশে গিয়েছি তাতে মনে হয়েছে আমরা একশতগুন পেছনে। আমি তাঁর সততায় মুগ্ধ হয়েছি। ঐ সহকর্মীর উক্তি প্রমাণ করে আমরা শিক্ষার গুণগত মানের দিক থেকে অনেক পিছনে পড়ে আছি।
শিক্ষামান উন্নয়নে শিক্ষা উপকরণ একটি মস্তবড় প্রতিন্ধকতা সৃষ্টি করছ্।ে আমাদের কবিতা ও গদ্য সাহিত্য ভাষা শিক্ষার উপকরণের অভাব পূরণ করতে সমর্থ হলেও অন্য সকল ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব জ্ঞান ভান্ডার এখনও শুন্যের কোঠায়। একটি ভাল বইয়ের অভাব এতই প্রকট যে বিদেশী বইয়ের উপর নির্ভর করে চলছে উচ্চ শিক্ষা। যদিও দু একটি বাংলা বই পাওয়া যায়, তা হয় ভুলে ভরা বা বিদেশী বইয়ের ভাবানুবাদ। যদি কপিরাইট আইন আর্ন্তজাতিকভাবে মানার দাবী ওঠে তবে বাংলাদেশেকে চরম দু:র্দশায় পড়তে হবে। এই কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি না করে কে উপাচার্য হবেন, আর কে বিদায় নেবেন- এই আলোচনা ও আন্দোলনেই কাটছে আমাদের শিক্ষক রাজনীতি। এই সুবিধাবাদী রাজনীতিই আমাদের শিক্ষার মান ও নৈতিক মূল্যবোধপুষ্ট সুনাগরিক গড়ার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। একজন প্রকৃত শিক্ষকের উচিত সততাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে নতুন করে পথচলা শুরু করা। যেতে হবে অনেক দুর! হতাশায় তাই থামা নয়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকরা যতক্ষণ রাজনীতিতে ব্যয় করেন তার এক দশমাংশ যদি গবেষণায় ব্যয় করতেন বা ব্যয় করবার সুযোগ পেতেন তাহলে দেশের অপরিমেয় উন্নতি হত। আর নিয়মিত কর্ম ঘন্টার যদি দুই দশমাংশ সময় অতিরিক্ত যুক্ত করতেন পড়ালেখায় তাহলে বহি:বিশ্বে জ্ঞান বিপনন করতে পারতো দেশ। আমরা সেসব দিকে নজর না দিয়ে কেবলই রাজনীতি আর রাজনীতি নিয়ে আছি।
আজ যারা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার মহান দায়িত্ব পেয়েছেন তাঁরাতো আছেন নিজ পদ সামলাতে ব্যস্ত। বিগত কয়েকটি মাস আমার কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একটি শিক্ষক গ্রৃুপ ছাত্র-শিক্ষক-সরকারকে তটস্থ করে রেখেছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের উদ্বেগ: দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংশ করছে। মেধাবীকে বঞ্চিত করে লাঠিয়াল(!) নিয়োগ দিচ্ছেন বর্তমান উপাচার্য ও তাঁর দলীয় প্রশাসন। তাঁদের উদ্বেগ কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা সময় পেরলেই বোঝা যাবে। তবে আমি নিশ্চিত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কোথাও কোথাও যোগ্যতার অবমূল্যায়ন হয়েছে। সেটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া অবশ্যই সবার জন্য জরুরী। আর ঐ ব্যাপারে সরকার ও মহামান্য রাষ্ট্রপতির সহযোগিতা আমাদের কাম্য হতে পারে। তবে এই রিভিউ কমিটির কাজ বর্তমান সময়ের নিয়োগগুলিতে সীমাবদ্ধ রাখা যৌক্তিক হবে না। বরং, স্বাধীনতার পর যত অযোগ্য নিয়োগ হছে তা রিভিঊ কমিটির মাধ্যমে সংশোধন করে মেধাবী, সৎ ও ভাল মনের মানুষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান করে দেওয়া যেতে পারে। দিন বদলের যাত্রা এভাবেই হতে পারে। আমার কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে, ক্লাস বর্জন এবং উপাচার্য অপসারণ আন্দোলন করলে কোন সুফল আসবে না। বরং, ঐসব অযোগ্য শিক্ষকদের তালিকা ভারী হতে থাকবে। নতুন উপাচার্য যে অযোগ্য নিয়োগ দেবেন না তার গ্যারান্টি কী?
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার উদ্বেগে বিষয় হলো: শিক্ষকদের আন্দোলনের কর্মসূচী এবং পাল্টা কর্মসূচী শিক্ষা কার্যক্রমকে দারুণভাবে ব্যহত করছে। নষ্ট হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষক ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কগুলিও। ফলে নতুন করে সেসন জট সৃষ্টি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে। অশুভ রাজনীতির কালো ছায়া আরোও বিস্তর লাভ করছে। এই যদি হয় শিক্ষক রাজনীতির পরিণাম তাহলে দেশ কোথায় যাবে? এই নেতিবাচক রাজনীতি কি আমাদেরকে মূল্যবান কিছু দিতে পারে? আমার মনে হয়েছে, যারা আন্দোলন করছেন তাঁরা আজ এক আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পাঁ দিয়েছেন। আর তাই সেসনজট দূর করা এবং মানুষগড়ার কারিগরের ভূমিকা ছেড়ে অনেকেই রাজনীতিবিদ হয়ে ঊঠতে চাইছেন। তাতে দেশই ক্ষতির মুখে পড়ছে। পড়ছে নয় কী?
এই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। শাসকগোষ্ঠির তোষামোদকারীরা এই সুযোগে শিক্ষক রাজনীতি বন্দের একটি সুপারিশও হয়তো ইতিমধ্যে তৈরী করে ফেলেছেন! হয়তো তাঁরা একটি প্রতিশোধ নিতে চাইছেন। আর তাহল, যেহেতু আওয়ামী লীগ স্বায়ত্বশাসন দিয়েছিল, তাই আজ তাকে দিয়ে সেই স্বায়ত্বশাসন খর্ব করতে হবে। যাতে শিক্ষক রাজনীতি বন্দ করা যায়। এতে করে আগামীতে নির্যাতন ও শোষনের রাজত্ব কায়েম করা যায়।
আজ ছোটবেলায় পাঠ্য বইয়ের সেই গল্পটি খুব মনে পড়ে। গল্পটি প্লেটোকে নিয়ে। প্লাটো জ্ঞান চর্চায় এতই অনুরাগী ছিলেন যে, বিছানায় শুয়ে একহাতে বই রাখতেন আর অপর হাতে একটি ভারী বল রাখতেন যার নীচেয় ছিল একটি লিডেন পাত্র। যদি কখনও ঘুম আসতো তবে ঐ হাতের বলটি লিডেন জারে পড়তো আর অমনি তিনি ঝন ঝন শব্দে জেগে ঊঠতেন। আজ সেই সাধক নেই। আছে রাজনীতি আর রাজনীতি । সারারাত পরিকল্পনা করে কাটে কিভাবে উপাচার্য অপসারণ করা যাবে। আর উপাচার্যর বিনিদ্র রজনী কাটে কিভাবে এই তথাকথিত শিক্ষক রাজনীতিবিদদের সামাল দেবেন।
জাতির আকাংখা পূরণে ও বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে প্রয়োজন সরকারী বরাদ্দের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা। আন্দোলন সামাল দেওয়ার জন্য সেদিকে নজর না দিয়ে উপাচার্যকে দলভারী করতে হয়। ফলে লাইব্রেরীতে বই আসেনা, গবেষণাগারে থাকেনা যন্ত্র। শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে এসে ফিরে যায়। কারণ শিক্ষক আসেননি বা তিনি আন্দোলনের মিছিলে গেছেন। এ অবস্থা জাতির কাম্য নয়। আমাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যথার্থ ভুমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়।
কেবল শ্রম বিক্রি বা তৈরী পোষাক বিক্রি করে দেশ ও জাতির উন্নতি করা যাবে না। তথাকথিত শিক্ষক রাজনীতি ছেড়ে শিক্ষককে প্রকৃত শিক্ষক হতে হবে। দেশকে বানাতে হবে কহড়ষিবফমব ঘধঃরড়হ-এ। জাতির এ প্রত্যাশা পূরণে সরকার ও মহান রাষ্ট্রপতির অধিকতর মনযোগ ও হস্তক্ষেপ অনিবার্য। শিক্ষকদেরকেও বুঝতে হবে ক্লাস বর্জন, পরীক্ষা বর্জন বা গবেষণা বর্জন আন্দোলনের হাতিয়ার হতে পারে না। এটা শিক্ষক রাজনীতিকেই কেবল প্রশ্নবিদ্ধ করে না বরং নিজেকে জাতির কাছে হেয় প্রতিপন্ন করে। আমরা একটি সম্মানিত জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিতে চাই। সে সংগ্রামে সবাইকেই প্রয়োজন-এ সত্য সকল পক্ষকেই অনুধাবন করতে হবে।
নেতিবাচক রাজনীতি কেবল শিক্ষকদের সম্মান ভুলুন্ঠন করে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত এ জাতির সম্মান সমুন্নত রাখতে শিক্ষক সমাজের ভুমিকা সবচাইতে বেশী। জনগণ দায়িত্বশীল শিক্ষক চায়। আমরা কি আরোও মননশীল, সহনশীল, দরদী ও সৃজনশীল হতে পারি না? শিক্ষক রাজনীত হোক কল্যাণের ও উন্নয়নের যা আমাদের সকলের দাবী। আমরা অবশ্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে মুক্ত জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে দেখতে চাই। কোন ক্যাম্পাসেই কোন বিশেষ গোষ্ঠী, বা বিশেষ সংগঠন বা বিশেষ অঞ্চলের স্বার্থান্বেষীমহলের দখলদারিত্ব দেখতে চাই না। আমরা চাই একটি মুক্ত ক্যাম্পাস, যেখানে কোন নিপীড়ন বা নির্যাতনের শঙ্কা থাকবে না। উপাচার্য হবেন একজন ন্যায়বান, বিদ্যানুরাগী স্বজন। যদি কোন উপাচার্য উন্নত মানসিকতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপদেষ্টা ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি অবিলম্বে ক্যাম্পাসগুলি রাহমুক্ত করতে দ্বিধা করবেন না। অপর দিকে কোন শিক্ষক যদি রাজনীতির নামে পরিবেশ নষ্ট করেন তাহলেও তাকে অপসারণ করবেন। গণতন্ত্র রক্ষায় যেমন আমরা মূল্যবান ভূমিকা রেখেছি, তেমনি আজ প্রয়োজন কল্যাণের শিক্ষক রাজনীতি। আর যেন কোন উপাচার্যকে উচ্চারণ না করতে হয়: “তোমাদের আমরা এই শিখিয়েছি; এই শিক্ষা দিয়েছি?”
Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2012/teachers-and-politics/
Copyright ©2024 PriyoAustralia.com.au unless otherwise noted.